শামীম ওসমান মাঠে নেই, আছে তাঁর ছায়া

নারায়ণগঞ্জ মেইল: নির্বাচনী প্রচারে সরগরম নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকা। তবে ভোটের মাঠে কোথাও এখানকার সরকারি দলের সাংসদ শামীম ওসমানের উপস্থিতি নেই। তবে আলোচনায় আছে তাঁর নাম। এখানকার আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে তাঁর বিরোধের বিষয়টিও সামনে আসছে। এখানে আইভীর প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির তৈমুর আলম খন্দকারের প্রতি ভেতরে-ভেতরে সাংসদের সমর্থন থাকার গুঞ্জনও আছে শহরে। তাই অনেকে বলছেন, এই ভোটে শামীম ওসমান না থাকলেও তাঁর ছায়া আছে।

নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও দলটির নেতা তৈমুর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পেছনে শামীম ওসমানের ইন্ধন আছে বলে আইভীর অনুসারীরা সন্দেহ করেন। তৈমুর আলম বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। তাঁর ভাই মাকসুদুল আলম (খোরশেদ) নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, এবারও তিনি নির্বাচন করছেন। তাঁর ওয়ার্ডে প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের মহানগর সহসভাপতি রবিউল হোসেন। সাংসদ শামীমের অনুসারী হিসেবে পরিচিত রবিউল মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

এলাকায় প্রচার আছে, তৈমুরের ভাই খোরশেদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমাতেই সাংসদের পরামর্শে রবিউল সরে গেছেন। যাতে খোরশেদ মেয়র প্রার্থী তৈমুরের জন্য বেশি সময় দিতে পারেন। এ অভিযোগে রবিউলকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ মহানগর হেফাজতে ইসলামের বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌসুর রহমান প্রকাশ্যে মতবিনিময় সভা করে তৈমুরকে সমর্থন দিয়েছেন। হেফাজতের এই নেতাও শামীম ওসমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে শামীম ওসমানের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তবে তিনি নির্বাচন সম্পর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে আপাতত গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

তবে সাংসদ শামীম ওসমানের একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, মেয়র আইভীর সঙ্গে শামীম ওসমানের বিরোধ দূর হয়নি। মাস দুয়েক আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কবরস্থানে শ্মশানের মাটি ফেলা নিয়ে শামীম ওসমান মনঃক্ষুণœহয়েছেন। তাঁর মা–বাবার কবরেও মাটি ফেলা এবং এ বিষয়ে মেয়র আইভীর আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নিয়ে শামীম ওসমান বেশ ক্ষুব্ধ।

ওই সূত্র বলছে, শামীম ওসমানের প্রত্যাশা ছিল, আইভী তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবেন। এখন তিনি দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সরাসরি কোনো নির্দেশনা আশা করছেন।

তবে সাংসদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত প্রথম আলোকে বলেন, আচরণবিধির জন্য সাংসদ শামীম ওসমান মাঠে নামছেন না; তিনি সবাইকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারের নির্দেশনা দিয়েছেন। তাঁর অনুসারীসহ দলের সবাই মাঠে আছেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমুর আলমকে ভেতরে-ভেতরে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে আবু হাসনাত দাবি করেন, শামীম ওসমানকে ফাঁসানোর জন্য এ অপপ্রচার। বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত মিলেই তৈমুর নির্বাচন করছেন। তাঁর সঙ্গে আপস সম্ভব নয়।

জানা গেছে, আইভীর পাশাপাশি এই আবু হাসনাত এবং মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি চন্দন শীল ও সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহাও এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। এই তিন নেতাই শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। আইভীর ভোটের কথা বলে এক যুবলীগ নেতার কাছে ৫ লাখ টাকা চেয়ে খোকন সাহার একটি ফোনালাপ ইতিমধ্যে বিতর্ক ছড়িয়েছে। যদিও আইভীর প্রচারে তাঁর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় নেতারা নারায়ণগঞ্জ এলে তাঁদের সঙ্গে সবাই উপস্থিত থাকছেন। তবে শামীম ওসমান সেখানেও থাকছেন না। উপরন্তু তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীকে গোপনে ইন্ধন বা সাহস জোগাচ্ছেন বলে নারায়ণগঞ্জে প্রচার রয়েছ

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এভাবে বলতে চাই না; সাধারণ মানুষ এমন চিন্তাভাবনা করে, অনেকেই এ বিষয়টি বলছে। তবে আমার মনে হয়, কোনো না কোনো ইন্ধন তো অবশ্যই আছে। দলের সমর্থন ছাড়াই তিনি (তৈমুর) নির্বাচন করছেন, কারও সাহস নিশ্চয়ই পেয়েছেন। কারা ইন্ধন দিল, এটা নিয়ে ভাবছি না। যারা ইন্ধন দিচ্ছে বলে মানুষ মনে করে, তাদের বিরুদ্ধেও একসময় নির্বাচন করেছি।’

২৭টি ওয়ার্ড নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ৯টি ওয়ার্ড শামীম ওসমানের নির্বাচনী এলাকা নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের অধীনে। আর ১৮টি ওয়ার্ড নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের অধীনে। এ আসনের সাংসদ জাতীয় পার্টির (জাপা) সেলিম ওসমান, যিনি শামীম ওসমানের ভাই। নৌকার প্রার্থী আইভীকে ইতিমধ্যে সমর্থন দিয়েছে ১৪-দলীয় জোট ও এখানকার নাগরিক কমিটি। তবে জাপা এখন পর্যন্ত কাউকে সমর্থন দেয়নি। তাদের নিজেদেরও প্রার্থী নেই। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর জাপার আহ্বায়ক আকরাম আলী প্রথম আলোকে বলেন, জাপা বা জাপার সাংসদের কাছে এখন পর্যন্ত কেউ সমর্থন চায়নি। নৌকার প্রার্থী সমর্থন চাইলে দলীয়ভাবে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আগ বাড়িয়ে তাঁরা কিছু করতে রাজি নন।

এদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে না নামার ঘোষণা দিলেও তৈমুরের পক্ষে প্রচারে সরব আছেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। দলীয় আদেশ অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় জেলা বিএনপির আহ্বায়ক পদ থেকে তৈমুর আলমকে অব্যাহতি দিয়েছে দল। ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব পান মনিরুল ইসলাম। দায়িত্ব নিয়েই তিনি তৈমুরের নির্বাচনী প্রচারে নেমে পড়েছেন।

গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী এস এম আকরামও তৈমুরকে সমর্থন দিয়েছেন। তৈমুরের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হলেন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় পরিচয়ে নয়, সামাজিক আন্দোলনের দায়বদ্ধতা থেকে মেয়র পরিবর্তনের জন্য নির্বাচনী প্রচারে নেমেছেন। তৈমুরের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়নি কেন্দ্রীয় বিএনপি।

তৈমুরের ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল। এর আগে কুমিল্লায় মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মনিরুল হক সাক্কুকে বিএনপি কাছে টেনে নিয়েছে। এখানেও জেলা বিএনপি, মহানগর, এমনকি কেন্দ্রীয় আইনজীবী ফোরামের নেতারা মিছিলে অংশ নিয়েছেন, পত্রিকায় ছবি এসেছে। নির্বাচন করায় নেতা-কর্মীরা ঘর থেকে বের হতে পারছেন। মিছিল থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির স্লোগান দিতে পারছেন।

নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও দলটির নেতা তৈমুর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পেছনে শামীম ওসমানের ইন্ধন আছে বলে আইভীর অনুসারীরা সন্দেহ করেন। তৈমুর আলম বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। তাঁর ভাই মাকসুদুল আলম (খোরশেদ) নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, এবারও তিনি নির্বাচন করছেন। তাঁর ওয়ার্ডে প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের মহানগর সহসভাপতি রবিউল হোসেন। সাংসদ শামীমের অনুসারী হিসেবে পরিচিত রবিউল মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

তৈমুর আলম খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারে ডানে-বাঁয়ে সব বিএনপির নেতা-কর্মী। যে ওয়ার্ডে প্রচারে যাচ্ছি, সেখানে ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি সভাপতিত্ব করছেন।’ আওয়ামী লীগের সাংসদ শামীম ওসমানের গোপন সমর্থন পাওয়ার প্রচার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাংসদ ভিন্ন দলের, তাঁর আলাদা চিন্তা থাকতে পারে। কিন্তু আমি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত এককভাবে নিয়েছি। এই সাংসদও একসময় আমাকে গুলি করেছেন, আমার চেম্বারে আগুন দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে বছরে আমার মাত্র দুবার দেখা হয়।’

১৬ জানুয়ারি ভোট গ্রহণ হবে। আইভী-তৈমুর ছাড়াও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাসুম বিল্লাহ্ (হাতপাখা), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির রাশেদ ফেরদৌস (হাতঘড়ি), খেলাফত মজলিসের এ বি এম সিরাজুল মামুন (দেয়ালঘড়ি), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের জসীমউদ্দীন (বটগাছ) প্রতিদিনই প্রচারে নামছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল ইসলাম (ঘোড়া) এখনো প্রচারে নামেননি।

শামীম ওসমান ও আইভীর বিরোধের বিষয়টি নির্বাচনী প্রচারেও ব্যবহার করছেন তৈমুর আলম। তিনি নির্বাচিত হলে সাংসদ শামীম ওসমানের সঙ্গে সমন্বয় করে নারায়ণগঞ্জের উন্নয়ন করবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন। এ প্রতিবেদকের কাছেও তিনি বিষয়টি উল্লেখ করেন।

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রফিউর রাব্বি প্রথম আলোকে বলেন, শামীম ওসমানরা কখনো সুস্থ রাজনীতি করেন না, পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি করেন। নিজেদের অনুগত রাখতে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি ও হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত করেছেন। এবার আইভীর বিরোধিতা করে তৈমুরকে মাঠে নামিয়েছেন। তাঁর পক্ষে ভেতরে-ভেতরে কাজ করছেন।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

নারায়ণগঞ্জ মেইলে এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

সর্বশেষ