নারায়ণগঞ্জ মেইল: নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে এক উজ্জল নক্ষত্র ছিলেন প্রয়াত সাংসদ একেএম নাসিম ওসমান। তার বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি বহু নেতাকর্মী তৈরী কওে গেছেন যারা আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। অথচ তার মৃত্যুর পরে তার পরিবারটিই হয়েছে সবচেয়ে বঞ্চিত। তার ছেলে কিংবা স্ত্রী কেউ এখন পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হতে পারেননি। অথচ নাসিম ওসমানের আসনেই তার ছোট ভাই সেলিম ওসমান দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সংরক্ষিত নারী আসনেও নাসিম ওসমান পত্নী পারভিন ওসমানের মনোনয়ন ঠেকিয়ে দেয়া হয়েছে অদৃশ্য ইশারায়। তাই নাসিম ওসমান অনুসারীরা ক্ষোভ আর দু:খভরা কন্ঠে বলেন ‘রাজনীতি থেকে পেলেন নাসিম ওসমান পরিবার’।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে রাজনীতিতে ঐতিহ্যবাহী ওসমান পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। প্রায় তিন পুরুষ যাবত এ পরিবারের সদস্যরা নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে ভূমিকা রেখে আসছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তাদের চতুর্থ প্রজন্মও শুরু করেছে রাজনৈতিক পথচলা। এ পরিবারের রাজনৈতিক ইতিহাসের শুরু খান সাহেব ওসমান আলীর হাত ধরে। এরপর একেএম সামসুজ্জোহা ও একেএম নাসিম ওসমানের মাধ্যমে তা পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে। এ পরিবারের তুমুল জনপ্রিয় নেতা নাসিম ওসমানের হাত ধরে রাজনৈতিক মাঠে পথচলা শুরু তারই অনুজ একেএম শামীম ওসমানের যিনি এখন পর্যন্ত সে হাল ধরে আছেন। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম একেএম আজমেরী ওসমান ও একেএম অয়ন ওসমানও রাজনীতিতে হাতেখড়ি নিয়ে নিয়ে নিয়েছেন, যাদেরকে নেতৃত্বে দেখতে উন্মুখ হয়ে আছে নারায়ণগঞ্জবাসী।
এদিকে গত এক দশকের রাজনীতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঐতিহ্যবাহী ওসমান পরিবারের নেতৃত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা একেএম নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পরে আকষ্মিকভাবে পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে দুর্দান্ড প্রতাপশালী নেতা একেএম নাসিম ওসমানের পরিবার থেকে নেতৃত্ব বিকশিত হওয়ার পথে পদে পদে অন্তরায় সৃষ্টি হতে থাকে। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ত্বকী হত্যাকান্ডে জড়ানো হয় প্রয়াত সাংসদ নাসিম ওসমানের পুত্র আজমেরী ওসমানকে। যদিও তাদের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ বারবার অস্বীকার করা হয়েছে। নাসিম ওসমান ঘনিষ্ঠদের দাবি, সুষ্ঠ তদন্ত হলে ত্বকী হত্যাকান্ডে জড়িত প্রকৃত আসামীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। তাছাড়া অনেকে মনে করেন প্রকৃত ঘটনা আড়াল করতে একটি মহল আজমেরী ওসমানকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এছাড়াও একেএম নাসিম ওসমানের সহধর্মীনী পারভীন ওসমানকেও নেতৃত্বে আসতে বারবার বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে মনে করেন এ পরিবারের বর্ষিয়ান অনেক শুভাকাঙ্খী যারা দীর্ঘসময় নাসিম ওসমানের সাথে রাজনীতি করেছেন। তাদের মতে, নাসিম ওসমানের যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে তার সহধর্মীনী পারভীন ওসমানকে তার যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। চারবারের সাংসদ নাসিম ওসমান পত্নী এখনও পর্যন্ত জাতীয় কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে কোনো জনপ্রতিনিধি হতে পারেননি, যা বিষ্ময়ের জন্ম দিয়েছে নাসিম ওসমান অনুসারীদের মনে। বিভিন্ন ইস্যুতে মা-ছেলেকে বারবার কোনঠাসা করে রাখার চেষ্টা করছে একটি মহল- এমনটাই দাবী তাদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রয়াত সাংসদ একেএম নাসিম ওসমান ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের সকলের সাথে হত্যা করার আগের দিন ১৪ আগস্ট তিনি পারভীন ওসমানকে বিয়ে করেন। বিয়েতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র শেখ কামাল উপস্থিত ছিলেন। ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ঘরে নববধুকে ফেলে রেখেই চলে গিয়েছিলেন। তিনি ঢাকায় প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর তিনি আবার ভারতে চলে যান এবং সেখানে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তৎকালীন কাদের বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।
নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নাসিম ওসমানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই নাসিম ওসমানের মুত্যুর পর ধীরে ধীরে অবহেলিত হতে থাকে তার স্ত্রী পারভীন ওসমান ও পুত্র আজমেরী ওসমান। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার কথা ছিল পারভীন ওসমানের। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে সেটাও হয়নি। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদেও নাসিম ওসমান পত্নী পারভীন ওসমান একজন যোগ্য প্রার্থী ছিলেন কিন্তু এখানেও সেই অদৃশ্য শক্তির হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের আপামর জনসাধারণ। নেপথ্যের সেই অদৃশ্য কুশিলবদের খুঁজে বের করা এখন সময়ের দাবিতে পরিনত হয়েছে।