নারায়ণগঞ্জ মেইল: যুগে যুগে বিভিন্ন রাজা বাদশাহদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সিংহাসনের জন্যে ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধের ঘটনা। নিজে সিংহাসন দখল করতে ভাইকে হত্যা করার ঘটনাও ইতিহাসে কম নেই। কিন্তু সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে সেসব আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বিলুপ্তপ্রায় সে কল্পকাহিনীর নতুন সংস্করনের জন্ম দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের দুই ভাই এড. তৈমূর আলম খন্দকার ও মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। তাদের আরেক ভাই প্রয়াত ব্যবসায়ী নেতা সাব্বির আলম খন্দকারের হত্যাকারীদের সাথে আপোষ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের মাধ্যমে আজ তারা প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবীদ হয়েছেন-আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারানো সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলা পর্যালোচনা করলে এবং তৎপরবর্তী দুই ভাইয়ের রাজনৈতিক উত্থান বিবেচনায় এমনটাই প্রতিয়মান হয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
মামলা পরিচালনায় রাষ্ট্রপক্ষের তৎকালীন কৌশলী পিপি এড. ওয়াজেদ আলী খোকন মামলার অবস্থা সম্পর্কে নারায়ণগঞ্জ মেইলকে জানিয়েছিলেন, মামলার চার্জশীট জমা দেওয়ার পরে এখনো পর্যন্ত বিচার কাজ শুরুই করা যায়নি। মামলার বাদী এড. তৈমূর আলম খন্দকার নিজেই চাননা মামলার বিচার কাজ শুরু হোক। কারন এখনো পর্যন্ত তিনি একদিনও আদালতে আসেননি কিংবা কোন স্বাক্ষীকেও হাজির করেননি। প্রতিটি তারিখে সমন পাঠানো হয়েছে কিন্তু গত এক যুগেরও বেশী সময় পার হয়ে গেলো বাদী পক্ষের কাছ থেকে কোন প্রকার সাড়া পাওয়া যায়নি। যার কারনে মামলার বিচার কাজও শুরু করা যায়নি।
পিপি আরো বলেছিলেন, মামলায় বিএনপির তৎকালীন সাংসদ গিয়াসউদ্দিনসহ বিএনপি নেতাকর্মীদেরই আসামী করা হয়েছিলো। দলের লোকরা এতে ইনভলব থাকায় সম্ভবত মামলাটি নিজেরাই মিমাংসা করে ফেলেছেন তারা। যদি আওয়ামীলীগের কেউ জড়িত থাকতো তাহলে হয়তো তারা বিচার কাজ চালাতো বলে আমার মনে হচ্ছে। এখন মনে তারা মামলাটি নিজেদের মধ্যে আপোষ মিমাংসা করে ফেলেছে।
এ বিষয়ে জানতে এড. তৈমূর আলম খন্দকারকে ফোন করা হলে তিনি ‘মিটিংয়ে ব্যস্ত আছি’ বলে ফোন লাইন কেটে দেন।
সূত্রে প্রকাশ, দীর্ঘ প্রায় ১৯ বছর ধরে আপন ভাই সাব্বির আলম খন্দকার হত্যার বিচার দাবি করে আসছেন বড় ভাই তৈমূর আলম খন্দকার ও ছোট ভাই মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। কিন্তু রহস্যজনক হলো এই মামলার বাদী তৈমূর আলম খন্দকার আদালতে এখনও স্বাক্ষীই দেননি। প্রায় ১৫ বছর ধরে ওই মামলায় আদালতে বাদী হিসেবে হাজিরই হয়নি তৈমূর আলম খন্দকার। যাদেরকে ‘খুনি‘ বলে অভিযোগ তুলেছিলেন সেই খুনিদের সঙ্গেই মেয়র হওয়ার লোভে ২০১১ সালে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আপোষ করেছিলেন তৈমূর আলম। আপোষ শর্তে মামলার রিভিশন প্রত্যাহার করেছিলেন তিনি।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। সেই ২০০৬ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতে এই চার্জশিট দাখিল করা হয়। চার্জশিট থেকে সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দীনসহ বেশকজনকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়। ওই চার্জশিটের বিরুদ্ধে না রাজি পিটিশন দাখিল করেছিলেন। না রাজি পিটিশন খারিজ করে দেন আদালত। ফলে আসামিরা মামলা থেকে অব্যাহতি পান। কিন্তু তারপরেও ছাড় দেননি তৈমূর আলম। তিনি নারাজি পিটিশন খারিজের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিভিশন করেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে চলে আসে ২০১১ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ওই নির্বাচনে বিএনপির সমর্থিত মেয়র প্রার্থী হন তৈমূর আলম খন্দকার। নির্বাচনে তৈমূর আলমের পক্ষে নামাতে গিয়াসউদ্দীন ও জাকির খানের বাসায় যান। ওই সময় তাদের দাবি ছিল- সাব্বির আলম খন্দকার হত্যা মামলার নারাজি খারিজের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রিভিশন পিটিশন প্রত্যাহার করতে হবে। তাহলে গিয়াসউদ্দীন ও জাকির খানের লোকজন তৈমূর আলম খন্দকারের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নামবেন। তাদের দাবি মতে তৈমূর আলম খন্দকার রিভিশন প্রত্যাহার করে নেন এবং না রাজি খারিজ মঞ্জুর হয়ে যায়। ফলে পুলিশের দেয়া চার্জশিট বহাল থাকলেও অব্যাহতির আবেদন করা আসামিরা মামলা থেকে ছাড় পান।
আদালতে খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, মামলাটি নিয়ে বাদীর কোন আগ্রহ নেই। মামলাটির ধার্য্য তারিখে বাদী তৈমূর আলমকে উপস্থিত দেখা যায়না। ফলে এই মামলার নথিপত্র খুঁজতেও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। ঘটনা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রাতঃভ্রমনের সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন সাব্বির আলম খন্দকার। এ ঘটনায় বিএনপির দলীয় এমপি গিয়াসউদ্দীন, জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খান, গিয়াসের শ্যালক জুয়েল, জাকির খানের ভাই জিকু খান, মামুন খান, অহিদুল হক ছুক্কু, আব্দুল আজিজ বাচ্চু, মনিরুল ইসলাম সজল, ডিব্বা হালিম সহ ১৭ জনের নাম উল্ল্যেখ করে মামলা দায়ের করেন তৈমূর আলম খন্দকার। ঘটনার পর থেকে গিয়াসউদ্দীনকেই সাব্বির আলমের খুনি হিসেবে অভিযুক্ত করে আসছিলেন তৈমূর আলম। পরবর্তীতে দীর্ঘ ৩৪ মাস তদন্ত শেষে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা ২০০৬ সালে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলায় ৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। যেখানে গিয়াসউদ্দীন ও তার শ্যালক জুয়েলকেও অব্যাহতি দেয়া হয়। এই চার্জশিটের বিরুদ্ধে আদালতে না রাজি দেন তৈমূর। না রাজি খারিজ হয়ে গেলে তিনি উচ্চ আদালতে রিভিশন করেন। মেয়র নির্বাচনে গিয়াসউদ্দীনকে পক্ষে নামাতে সেই রিভিশন প্রত্যাহার করেন এবং না রাজি খারিজ হয়ে যায়। ফলে আসামিরা অব্যাহতি পান।
বর্তমানে বছরে একদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি সাব্বির আলম হত্যার বিচার দাবি করেন তৈমূর। শহরে শোক র্যালী, সন্ত্রাসী ও মাদকবিরোধী দিবস দাবি এবং নিহতের করব জিয়ারত করেন। কিন্তু তৈমূর আলমের এমন কর্মসূচিতে কখনই উপস্থিত দেখা যায়নি নিহত সাব্বির আলম খন্দকারের পরিবারের কোন সদস্যকে। তবে যাদের অভিযুক্ত করে আসামি করেছিলেন সেই মনিরুল ইসলাম সজলকে দেখা যায় বিচার দাবির কর্মসূচিতে। আসামি হওয়া অহিদুল হক ছুক্কু, ডিব্বা হালিমকেও তৈমূর আলমের সঙ্গে রাজনীতিতে দেখা গেছে। সারা বছর তৈমূর আলম মিডিয়াতে বক্তব্য দেন। কিন্তু তার ভাইয়ের মামলার ধার্য্য তারিখে তাকে কোন বক্তব্য দিতে দেখা যায়না। কারন তিনি মামলার কোন খোঁজ খবরও নেননা।