নারায়ণগঞ্জ মেইল: দায়িত্বে অবহেলা আর ব্যর্থতার অভিযোগে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিলো নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির কমিটি, গঠিত হয়েছে আহবায়ক কমিটি। একই অভিযোগ রয়েছে মহানগর বিএনপির বিরুদ্ধেও তবে সিদ্ধিরগঞ্জের ১০টি ওয়ার্ড বিধি বহির্ভূতভাবে বাদ দেয়ায় আদালতে চলমান মামলার কারনে এখনও টিকে আছে এড. আবুল কালাম ও এটিএম কামালের বিতর্কিত কমিটি। সিদ্ধিরগঞ্জের ১০টি ওয়ার্ডের সীমানা জটিলতার নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ভাঙ্গা যাচ্ছেনা মহানগর বিএনপির কমিটি আর তাই জেলা বিএনপির চেয়েও বেশী ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েও কমিটি নিয়ে এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন কালাম কামাল জুটি।
জানা যায়, বিএনপির গঠনতন্ত্র বহির্ভূত কমিটি গঠন করায় নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সকল কার্যক্রম স্থগিত করেছিলো নারায়ণগঞ্জের একটি আদালত। ২৮ নভেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র সহকারি জজ শিউলী রানী দাসের আদালতে শুনানি শেষে এ আদেশ দেন আদালত । ওই মামলার বাদী গোলজার খানের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাদী ও বিবাদী পক্ষের শুনানি শেষে আদালত বিরোধীয় কমিটির সকল কার্যক্রম স্থগিত করেন। বিরোধীয় কমিটির বিষয়ে হওয়া মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই কমিটির সকল কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত। আদেশে বলা হয় মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিরোধীয় কমিটির সকল কার্যক্রম বাদী ও বিবাদীকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন নিয়ে মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করায় বিএনপির গঠনতন্ত্রের কোথাও আসন ভিত্তিক কমিটি গঠনের নিয়ম বিবাদী পক্ষ আদালতে উপস্থাপন করতে পারেনি।
আদালত সূত্রে জানা যায়, বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৪ এর (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা/থানা, পৌরসভা, মহানগর, জেলা- এই শব্দগুলো বাংলাদেশ সরকার/ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক দেওয়া অর্থই বুঝাবে।’ অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকারের নির্ধারিত এসব এলাকা নিয়েই বিএনপির কমিটি গঠন করতে হবে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে মহানগরীর মুল এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জের ১নং থেকে ১০নং ওয়ার্ড পর্যন্ত এলাকা জেলা বিএনপির সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয় যেখানে মহানগর কমিটিতে রাখা হয়নি। আর সিটি কর্পোরেশন গঠন করেন সরকার এবং এখানে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের আয়োজন করেন। ফলে মহানগর বিএনপির কমিটি সুস্পষ্টভাবে দলের গঠনতন্ত্র বহির্ভুত কমিটি গঠন করা হয়েছে মর্মে বাদী পক্ষের আইনজীবী আদালতে উপস্থাপন করেন।
শুনানিতে বিবাদী পক্ষ স্থগিতের বিরুদ্ধে আপত্তি জানান। এর আগে আদালতে মামলার বাদী গোলজার হোসেন শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন এলাকা নিয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করায় কমিটির সকল কার্যক্রম স্থগিতের আবেদন করেন।
জানা গেছে, এর আগে গত ১২ নভেম্বর মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর ১০নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি গোলজার খান ও একই ওয়ার্ডের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক (সাবেক পৌর এলাকা) বিএনপি নেতা নূরে আলম শিকদার বাদী হয়ে একই আদালতে মামলাটি করেন। মামলার শুনানি শেষে পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে কেন কমিটি অবৈধ হবে না জানিয়ে বিবাদীদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন আদালত। পরদিন ১৩ নভেম্বর বুধবার আদালত থেকে এ সংক্রান্ত নোটিশ বিবাদীদের হাতে পৌঁছানো হয়। এ বিষয়ে আদালতে বিবাদীরা জবাব দেন।
এরপর গত ১৯ নভেম্বর বিরোধীয় কমিটির বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আদালতের কাছে কমিটির সকল কার্যক্রম স্থগিতের আবেদন করেন বাদী গোলজার হোসেন। ওই আবেদনের বিষয়ে ২৮ নভেম্বর বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে আদালতে কমিটির সকল কার্যক্রম স্থগিত রাখার আদেশ দেন।
জানাগেছে, দলের গঠনতন্ত্র বহির্ভূত নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর বিএনপির কমিটি গঠন করায় মামলায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনির, সেক্রেটারি অধ্যাপক মামুন মাহামুদকে মোকাবেলা বিবাদী এবং মহানগর বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল কালাম ও সেক্রেটারি এটিএম কামালকে মুল বিবাদী করা হয়। নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সীমানা ও গঠনতন্ত্র মানা হয়নি বলেও অভিযোগ করে ওই মামলা করা হয়।
মামলা দায়েরের পর বাদী গোলজার হোসেন খান অভিযোগ করেছিলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটিতে অল্প ক’জন নেতা স্থান পেলেও মহানগরের কমিটিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কপোর্রেশনের ১নং থেকে ১০নং ওয়ার্ড পর্যন্ত ১০টি ওয়ার্ডের কোনো নেতাই পদ পদবি পাননি। এই ১০টি ওয়ার্ডের মূল দলের নেতাকর্মীরা দলীয় পদ পদবির ক্ষেত্রে অবহেলার শিকার হচ্ছেন। দলের জন্য প্রাণপন কাজ করলেও দলের নেতারা তাদের কোনো পরিচয় দিচ্ছেন না। আমাদেরকে পদ পদবি যেন দেয়া হয় সেজন্যই এ মামলা। আমরা তো জাগোদল থেকেই যুক্ত বিএনপির সঙ্গে।
অন্যদিকে আরও জানাগেছে, ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আবুল কালামকে সভাপতি ও এটিএম কামালকে সেক্রেটারি করে ২৩ সদস্য বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ মহানগর আংশিক কমিটি গঠন করা হয় এবং একইদিন কাজী মনিরুজ্জামান মনিরকে সভাপতি ও অধ্যাপক মামুন মাহামুদকে সেক্রেটারি করে ২৬ সদস্য বিশিষ্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়।
কমিটি গঠনে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মুল এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ১০টি ওয়ার্ডকে জেলা বিএনপির সঙ্গে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। যেখানে সিটি কর্পোরেশনের ১নং থেকে ১০নং ওয়ার্ড রয়েছে। জেলা বিএনপির আওতাধীন এলাকা বন্দরের ৫টি ইউনিয়ন, সদর মডেল থানার আরও দুটি ইউনিয়নকে মহানগর কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই সময় স্থানীয় নেতারা দাবি করেছেন- জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আসনভিত্তিক সুবিধার বিষয়টি হিসেবে করেই দুটি কমিটি গঠন করা হয়।
এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপি’র সহ সভাপতি আতাউর রহমান মুকুল, সাংগঠনিক সম্পাদক শওকত হাশেম শকু, দপ্তর সম্পাদক হান্নান সরকারসহ একাধীক নেতা পদ পদবীতে বিএনপি ব্যবহার করলেও বিএনপি’র কোন আন্দোলন সংগ্রামে কখনো অংশ নেননি বরং সরকারী দলের এমপিদের সাথে ছিলো তাদের উঠা বসা। এমনকি গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় প্রতীক ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষে না থেকে প্রকাশ্যেই অবস্থান নিয়েছিলেন সরকারী দলের প্রার্থীর পক্ষে। নির্বাচনের আগে নির্বাচনী জনসভায় যোগ দিতে বিএনপির মহাসচিব মীর্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর নারায়ণগঞ্জে প্রবেশকালে মুকুল ও সুলতান তাদের লোকজন নিয়ে রাস্তায় আগুন জ্বেলে বাঁধা সৃষ্টি করেন। পরে নারায়ণগঞ্জের তৎকালীণ পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ নিজে বিএনপির মহাসচিবকে জনসভাস্থলে পৌছে দেন।
দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নেয়া এসব নেতাদের বিরুদ্ধে তাই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার দাবী উঠেছিলো তৃলমূলে। দল থেকে এসব নাম সর্বস্ব নেতাদের বহিস্কারের দাবীতে অনঢ় ছিলো নেতাকর্মীরা। আশা করেছিলো কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সময়ে বাদ দেয়া হবে এসব বেঈমান নেতাদের। সেই সাথে এসব নেতাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়া মহানগর বিএনপি’র সভাপতি এড. আবুল কালামের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিলো তৃণমূলের। দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন সংগ্রামে অনুপস্থিত থেকে এড. আবুল কালাম এ পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন বলে অভিমত নেতাকর্মীদের। তাছাড়া কালামের প্রশ্রয়েই মুকুল শকুরা দলের মধ্যে থেকে দলের বিরোধীতা করেছেন বলেও অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তাই মহানগর বিএনপি’র পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি প্রাধান্য পাবে বলে আশা ছিলো মামলা হামলায় জর্জরিত নারায়ণগঞ্জ বিএনপি’র নেতাকর্মীদের।
অথচ পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বহিস্কারের বদলে পুরস্কার স্বরূপ এসব বেইমান নেতাদের প্রমোশনের সুপারিশ করা হয়েছিলো বলে জানা গেছে। তবে কেন্দ্রীয় বিএনপি আগের কমিটিকে আর রদবদল না করেই পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন দিয়েছে। সেমতে মুকুল শকু আর হান্নান সরকারের মতো বিতর্কিত নেতারা থেকে গেছেন স্বপদে বহাল যা মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কোন ক্রমেই মেনে নিতে পারেনি। তাই কালাম কামালের প্রতি ক্ষুব্দ মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা আর সে কারনেই তাদের কমিটি ভেঙ্গে দেয়া এখন সময়ের দাবী।