ওসমান ঘনিষ্ঠদের প্রশ্রয় দিচ্ছে কারা?

নারায়ণগঞ্জ মেইল: প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল ওসমান পরিবারের জন্য। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের পুরোটা সময় নারায়ণগঞ্জে রাজত্ব ছিল ওসমান পরিবারের। সন্ত্রাসীদের গডফাদার শামীম ওসমানের নিয়ন্ত্রনে ছিল নারায়ণগঞ্জ শহর। আর ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে ৭২টি ব্যবসায়ী সংগঠন নিজের নিয়ন্ত্রনে রেখেছিলেন সেলিম ওসমান। ওসমান পরিবারের দুই সন্তান সন্ত্রাসী অয়ন ওসমান ও আজমেরী ওসমান নিজেকে নারায়নগঞ্জের কিং বলে পরিচয় দিতেন।


রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পুরো ওসমান পরিবার বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে পুরো নারায়ণগঞ্জ রেখেছিলেন হাতের মুঠোয়। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শামীম ওসমান হয়ে উঠেন নারায়নগঞ্জের অলিখিত মালিক। শামীম ওসমান প্রায় সময়ই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে প্রশাসনের সামনে প্রকাশ্যেই অহংকার করে নিজের অস্ত্রবাজিসহ নানা অপকর্মের কথা তুলে ধরতেন। বহু টর্চার সেল নির্মাণ করে গুম-খুন, নির্যাতন, প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, ক্যাডার বাহিনী নিয়ন্ত্রন, দুর্নীতি ও অনিয়মসহ নিজ দলের রাজনীতিবিদদের ঘায়েল ও প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে রাখতে শামীম ছিলেন দশে দশ! সর্বমহলেই তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকতো।


গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনে আওয়ামীলীগ সরকার পতন হলে বিদেশে পালিয়ে যায় ওসমান ওসমান পরিবার । ওসমান পরিবারহীন নারায়ণগঞ্জবাসী স্বস্থিতে থাকলেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ওসমান পরিবারের আতংক এখনো কাটেনি জনমনে। কেননা ওসমানীয় ঘনিষ্টজনরা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। বরং ধীরে ধীরে ওসমান পরিবারের নিয়ন্ত্রনে থাকা বিভিন্ন সেক্টর নিয়ন্ত্রনে নিচ্ছেন তারই ঘনিষ্টজনরা। ওসমান ঘনিষ্টজনদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ হাতেম, মনিরুল আলম সেন্টু, শওকত হাশেম শকু, আতাউর রহমান মুকুল।


মোহাম্মদ আলী:
নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির কথিত কিং মেকার ও সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ আলী ছিলেন ওসমান পরিবারের ঘনিষ্টজনদের মধ্যে অন্যতম। প্রয়াত নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে সেলিম ওসমান নির্বাচনে অংশ নিলে প্রথমে সেলিম ওসমানের পক্ষে ভোট চেয়ে ওসমানীয় সম্রাজ্যে যোগ দেন। এরপর থেকে ওসমান পরিবারের সাথে আওয়ামীলীগের বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নেন। মোহাম্মদ আলী নিজের রাজত্ব ধরে রাখতে সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী ও ওসমান পরিবার উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক রাখতেন। ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর ওসমান পরিবার পালিয়ে গেলেও তাদের বিভিন্ন সেক্টর নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা চালিয়ে যান মোহাম্মদ আলী। তার ভাতিজা ও ভাগ্নেরা দখলবাজী শুরু করেন ফতুল্লার বিভিন্ন এলাকায়। তবে ২৪ মার্চ দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে অনুদান বিতরণ অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে তোপের মুখে পড়েন মোহাম্মদ আলী। দীর্ঘদিনে অভ্যাসের কারণে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন তিনি। এই ব্যক্তব্যকে কেন্দ্র করে মোহাম্মদ আলীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রতিরোধের ঘোষণা দেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপুসহ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দরা। পরবর্তিতে সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষমা চান মোহাম্মদ আলী।


মোহাম্মদ হাতেম:
ওসমান পরিবারের ঘনিষ্টজনদের মধ্যে একজন মোহাম্মদ হাতেম। সেলিম ওসমান দীর্ঘসময় বিকেএমইএ’র সভাপতি থাকলে পরিচালনায় ছিলেন মোহাম্মদ হাতেম। ৫ আগস্টের পর সেলিম ওসমান আত্মগোনে থেকেই সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে হাতেমকে সভাপতি করেন। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হলে গত ১০ মে ড্যামি নির্বাচনের মাধ্যমে বিনা ভোটে ফের সভাপতি হন মোহাম্মদ হাতেম। হাতেম প্যানেলে সেলিম ওসমান পর্ষদের ২০ জন রয়েছে। মোহাম্মদ হাতেম সেলিম ওসমানের সহযোগি হয়ে বছরের পর বছর বিকেএমইএ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ৫ আগষ্টের পর ভোল পাল্টে সে বিকেএমইএ’র সভাপতি হয়ে সেলিম ওসমানের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন। পাশাপাশি আবির্ভূত হয়েছেন ঝুট বাবা হিসেবে। বিসিক এলাকায় ঝুট ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে ঘুরেফিরে হাতেমের নামটিই ব্যবহার করেন নানাজন। সরকার পতনের পরও গোটা ফতুল্লায় ঝুট ব্যবসার প্রচ্ছন্ন নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করেন হাতেম। ফ্যাসিস্টদের বিদায়ের পর বিকেএমইএতে ওসমানদের ছায়া হিসেবে মোহাম্মদ হাতেম এখনো তাদের নির্দেশনায় কাজ করছেন বলে অভিযোগ সর্বমহলে।


বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ২০২৪ সালের ২২ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সাথে বৈঠকে বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মো হাতেম বলেছিলেন, “যে তাণ্ডব আমরা গত কয়েক দিনে দেখেছি, আমরা আশা করব, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্য যারা আছেন, তারা উদযাঘটন করবেন এবং আইনের আওতায় আনবেন।“ব্যবসায়ী সমাজ আপনার (শেখ হাসিনা) পাশে ছিল, থাকবে।” হাতেম বলেন, “দুটো অনুরোধ। কারখানাগুলো যদি আমরা চালু রাখতে পারি, তাহলে শ্রমিকরা ভেতরে সুশৃঙ্খল পরিবেশে থাকবে। বাইরে থাকলে তাদের অন্যরা ব্যবহার করতে পারে, তাদের ভেতরে থাকাটাই নিরাপদ। “ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। স্বল্প পরিসরে হলেও ইন্টারনেটটা যাতে চালু করা যায়।” হাতেমের সেই ভিডিও ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।


মনিরুল আলম সেন্টু:
ওসমান পরিবারের অন্যতম সহযোগী ও ব্যবসায়ী পার্টনার মনিরুল আলম সেন্টু ফতুল্লা থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওসমান পরিবারের সাথে ঘনিষ্টতার কারণে দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তিতে আওয়ামীলীগে যোগদান করে গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। মহানগর আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ নিজামের সম্পদ বর্তমানে সেন্টুর নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। সেন্টুর বিরুদ্ধে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোনের হত্যা মামলা হলেও এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ফতুল্লা থানা বিএনপির একাংশ নেতাদের ম্যানেজ করে বহাল তবিয়তে রয়েছেন তিনি।


আতাউর রহমান মুকুল:
সেলিম ওসমানের অন্যতম ঘনিষ্টজন ছিলেন মহানগর বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি আতাউর রহমান মুকুল। সেলিম ওসমানের প্রতিটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন আতাউর রহমান মুকুল। যার ফলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। গত ৫ আগস্টের পর সেলিম ওসমান পালিয়ে গেলেও দাপট করেনি মুকুলের। ফের বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করার পাশাপাশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে নিজেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষনা করছেন।


শওকত হাশেম শকু:
মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১২নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সেলিম ওসমানের পক্ষে নির্বাচনী সভা করেছিলেন। এজন্য তাকে দল থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছিল। সেলিম ওসমানের ঘনিষ্টজনদের মধ্যে অন্যতম হলেন শকু। সেলিম ওসমানের অবর্তমানে শকুই সকল দায়িত্ব পালন করতেন। অথচ আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর সেই শকু বিএনপির নেতাদেও সাথে আতাঁত করে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টার করছেন। সম্প্রতি জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি জাকির খানের কারামুক্তির দিন তার সাথে দেখা গেছে শওকত হাশেম শকুকে।


রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ওসমান পরিবার আত্মগোপনে থাকলেও তাদের অবর্তমানে ঘনিষ্টজনরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সব কিছু নিয়ন্ত্রন করছেন। এমন পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জবাসী এখনো ওসমান পরিবারের হাতে জিম্মি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

নারায়ণগঞ্জ মেইলে এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

সর্বশেষ