নারায়ণগঞ্জ মেইল: নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতি ও ডায়াবেটিক হাসপাতালের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন ডাক্তার শাহনেওয়াজ চৌধুরী। শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) বিকেলে সংগঠনের বিশেষ সাধারণ সভায় লিখিত পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন চুন্নুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশেষ সাধারণ সভায় সংগঠনের জীবন সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় জীবন সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে বর্তমান কমিটির মেয়াদ আরও ৬ মাস বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এবং এই ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করে নতুন কমিটি গঠন করা হবে বলে জানানো হয়। বর্ধিত কমিটিতে সভাপতি ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরী সভাপতি পদে আর থাকবেন না এবং দু-একদিনের মধ্যে কার্যকরী কমিটি নতুন সভাপতি নির্বাচন করবেন- এমনটাই জানিয়েছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন চুন্নু।
প্রসঙ্গত, নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতি ও ডায়াবেটিক হাসপাতালের সভাপতি ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, জালিয়াতি ও স্বৈরাচারিতার নানা অভিযোগ উঠেছে অনেক আগেই। কিছুদিন আগে ডায়াবেটিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক এওয়াইএম হাশমত উল্লাহ সংবাদ সম্মেলন করে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি নানা ফিরিস্তি তুলে ধরেন।
মঙ্গলবার ২৮ ডিসেম্বর সকালে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শাহনাজ চৌধুরীর পদত্যাগ দাবি করে কালো ব্যানার নিয়ে মানববন্ধন করেন হাসপাতালের সামনে। মানববন্ধন থেকে বলা হয়, জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে সংস্থার সদস্যপদ পাওয়া ডা. শাহনাজ চৌধুরীকে অপসারণ করে হাসপাতালের সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হোক। এ লক্ষ্যে তারা নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ একেএম শামীম ওসমানের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এসব অভিযোগের বিষয় উল্লেখ করে একটি লিখিত অভিযোগপত্র নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতি ও ডায়াবেটিক হাসপাতাল সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন চুন্নুর কাছে দেয়া হয়েছে বলে জানানো হয় মানববন্ধন থেকে।
এদিকে একের পর এক অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন চুন্নুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়েছিলেন, সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি আমি জেনেছি এবং লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। আজকে আমাদের একটি মিটিং ছিলো। সে মিটিংয়ে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং এসব অভিযোগের বিষয়ে সঠিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য অ্যাডভোকেট শওকত আলীকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন, ফয়েজ উদ্দিন লাভলু, আজিজুল্লাহ এবং শামসুল ইসলাম। এই কমিটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। তখন এসব অভিযোগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
উল্লেখ্য গত ২৩ ডিসেম্বর সকালে নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতি ও ডায়াবেটিক হাসপাতালের সভাপতি ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, জালিয়াতি ও স্বৈরাচারিতার নানা অভিযোগে ডায়াবেটিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক এওয়াইএম হাশমত উল্লাহ শহরের গলাচিপা মসজিল সংলগ্ন সবুজ সার্থী সামাজিক সংগঠন এর কার্যালয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক এওয়াইএম হাশমত উল্লাহ লিখিত অভিযোগে বলেন, নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতির বর্তমান সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ডা. মো. শাহনেওয়াজ চৌধুরী। ২০১৯-২০২১ মেয়াদের জন্য তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। বিধি মোতাবেক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে হলে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত একটি ডিক্লারেশন ফরম পূরণ করতে হবে। উক্ত ডিক্লারেশন এবং নাডাসের গঠনতন্ত্র বিধিমালার পৃষ্টা ২৩ এবং ২৬ (খ) তে বলা আছে সমিতির কোন সদস্য যিনি নির্বাহী পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে ইচ্ছুক, তাকে সমিতির সহিত ব্যক্তিগত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি হতে মুক্ত থাকতে হবে। অথচ তিনি নাডাসের বিভিন্ন প্রজেক্টের কো অর্ডিনেটর হিসেবে বেতন ও ভাতা নিচ্ছেন এবং এইচবিএওয়ানসি প্রজেক্ট হতে কয়েক বছর ২০ শতাংশ কমিশন নিয়েছেন যা ডিক্লারেশন ফরম ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। শুধু তাই নয় ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরী জাল জালিয়াতির মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতির জীবন সদস্য হয়েছেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবত জীবন সদস্য না হয়েও সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করে অনেক সুবিধা ও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। সমিতির মূল রেজিস্টারে কোথাও তার নাম নাই। ১৬৩ নং সদস্য মরহুম গোলাম মোস্তফা ভূইয়ার নামটি কেটে তার নাম লিপিবদ্ধ করেন এবং একটি ভুয়া জীবন সদস্য ফরম মরহুম গোলাম মোস্তফা ভূইয়ার ফরমের উপর রেখে দেন, যা সম্পূর্ণরুপে জাল ও অসংগতিপূর্ণ।
গত প্রায় ১২ বছর যাবৎ ডা. মো. শাহনেওয়াজ চৌধুরী ক্ষমতা কুক্ষিগত করে আছেন। স্বজনপ্রীতি, অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে ডায়াবেটিক হাসপাতালকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছেন। তার মেয়ের জামাই ডা. মো. তাজুল ইসলাম মুন্নাকে ইতোপূর্বে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেন যা জেলা প্রশাসকের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির নিকট প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিনি নিয়োগ পরীক্ষার নাটক মঞ্চস্থ করেন। পুনরায় তার মেয়ের জামাইকে অধিক বেতনে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেন এবং তদন্ত রিপোর্টের প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের ৮ মাস পূর্ব থেকে লক্ষাধিক টাকা বেতন দেন যা সম্পূর্ণ স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অবৈধ। তার বড় মেয়ে ডা. শায়লা শারমীনকে ১ দিন শুক্রবার ডিউটি করার শর্তে পে-স্কেলের পূর্ণ সুবিধা প্রদান করেন। অন্য স্টাফদের ক্ষেত্রে এ সুবিধা দেয়া হয় না। এসব কর্মকান্ড করে তিনি স্বৈরাচার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
ডা. মো. শাহনেওয়াজ ল্যাব এর বিভিন্ন রি-এজেন্ট, মেডিকেল সামগ্রী, যন্ত্রপাতি, মেশিনারিজ, ইনসুলিন ইত্যাদি কোন কোটেশন, টেন্ডার ও ক্রয় কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়াই বায়োট্রেড ও অন্যান্য কোম্পানী হতে পরস্পর যোগসাজসে অধিক মূল্যে ক্রয় করে লাভবান হন যার কোন স্বচ্ছ হিসাব প্রদান করেন না। যে টিউব ও নিডেল ১০-১২ টাকায় পাওয়া যায় তিনি বায়োট্রেড হতে ২০ টাকায় ক্রয় করে প্রতি মাসে হাজার হাজার টাকা কমিশন পাচ্ছেন। জেলা পরিষদ থেকে ডায়াবেটিক হাসপাতালের ফিজিওথেরাপী বিভাগের জন্য ১৫ লক্ষ টাকা অনুদান বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু এই অর্থ ডা. মো. শাহনেয়াজ চৌধুরী সমিতির একাউন্টে জমা না দিয়ে দীর্ঘ প্রায় ১ বছর ব্যক্তিগত তহবিলে জমা রাখেন। পরবর্তীতে বিনা কোটেশনে, বিনা টেন্ডারে ও ক্রয় কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়াই তিনি ব্যক্তিগত ভাবে ফিজিওথেরাপী বিভাগের যন্ত্রপাতি ক্রয় করেন যার কোন স্বচ্ছ হিসাব প্রদান করেন নাই। কোন টেন্ডার কোটেশন ছাড়াই প্রায় পৌনে ২ কোটি টাকা দিয়ে হাসপাতালের আউটডোরের জন্য শেড নির্মাণ করেন যা ২ বছরের মধ্যে ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় পুনরায় মেরামত করা হয় যা সরেজমিনে পরিদর্শন করলে জানা যাবে। প্রায় পৌনে ৩ কোটি টাকা দিয়ে বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি টাকায় সিটি সেন্টারের জন্য ফ্লোর ক্রয় করেন কোন টেন্টডর কোটেশন ছাড়াই। ডা. শাহনেওয়াজ চৌধুরী জাল জালিয়াতির মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জ ডায়াবেটিক সমিতির জীবন সদস্য হওয়ায় অত্র সমিতির সভাপতির পদে থাকার নৈতিকতা হারিয়েও পাহাড় সমান দুর্নীতি করেও বহাল তবিয়তে এই প্রতিষ্ঠানের রাম রাজত্ব কায়েম করে চলেছেন।