নারায়ণগঞ্জ মেইল: রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে যেমন দূর থেকে কোনো যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তেমনিভাবে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারকে দূর থেকে একটি প্রভাবশালী মহল নিয়ন্ত্রণ করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, পর্দার আড়ালে থেকে কোন একটি অদৃশ্য হাতের ইশারায় দলীয় সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নেতাকর্মীদের বাঁধা উপেক্ষা করে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এই বিএনপি নেতা। নারায়ণগঞ্জ বিএনপি’র তৃণমূল নেতাকর্মীদেরও একই মত। তারা মনে করছেন, যেখানে দল নির্বাচনে যাচ্ছে না, সেখানে ব্যক্তি যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দলের ঊর্ধ্বে ব্যক্তির প্রাধান্য থাকতে পারে না। তৈমুর আলম খন্দকার অন্যের প্ররোচনায় দলের ক্ষতি করতে মেয়র প্রার্থী হয়েছেন, তিনি রিমোট কন্ট্রোল মেয়র প্রার্থী!
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনে বিএনপি দলীয় সমর্থনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কিন্তু নির্বাচনের আগের রাতে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচনে তাকে দলীয় প্রতীকে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি হননি। এরই ঠিক পাঁচ বছর পরে তৈমুরের দল বিএনপি যখন বর্তমান সরকার এবং সরকারের অধীনস্থ নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে তৈমুর আলম খন্দকার মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেন। তৈমুরের এই আকস্মিক পরিবর্তনে সন্দেহের দানা বাঁধে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মনে। অনেকে মনে করেন নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে উত্তর-দক্ষিণে যে বিরোধ চলমান রয়েছে সেই বিরোধের দক্ষিণের আইভীকে ঠেকাতে উত্তর মেরুর প্রেসক্রিপশনে মেয়র প্রার্থী হয়েছেন তৈমুর আলম খন্দকার।
২০১১ সালে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। দলীয় সমর্থনে সেবার মেয়র পদে প্রার্থী হন তৈমুর। কিন্তু নাটকীয় ভাবে নির্বাচনের আগের রাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। গণমাধ্যমকে সে সময় তৈমুর জানিয়েছিলেন দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তে তাকে নির্বাচন থেকে সরে আসতে হয়েছে এবং এটাকে তিনি নিজেকে কোরবানি করে ফেলার সাথে তুলনা করে বলেন, আমাকে বিনা গোসলে কোরবানি করে দেয়া হলো।
প্রথম নির্বাচনে পাওয়া আঘাত তৈমুর ভুলতে পারেননি। তাই ২০১৬ সালে দলীয়ভাবে তাকে প্রার্থী হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হলেও তিনি প্রার্থী হতে রাজি হননি। সেসময় তিনি জানিয়েছিলেন আমি বিনা গোসলে আর কোরবানি হতে চাই না।
বিনার গোসলে কোরবানি হওয়ার ভয় পুরোপুরি কেটে যায় তৈমুরের ২০২১ সালে এসে। এবার তৈমুর বীরদর্পে নির্বাচনের মাঠে নেমে পড়েন অথচ তখন দলীয়ভাবে সারাদেশের সকল নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দল যখন নির্বাচনের জন্য তাকে ডেকেছিলো, তখন তিনি না করে দিয়েছিলেন অথচ যখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার, তখনই নির্বাচনের জন্য তৈমুরের এই অতি উৎসাহ সন্দেহের জন্ম দিয়েছে সমালোচকদের মনে। অনেক মনে করছেন নারায়ণগঞ্জের কোনো এক প্রভাবশালী পরিবারের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য তৈমুর প্রার্থী হয়েছেন। দলীয় বিধিনিষেধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মেয়র প্রার্থী ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভীর বিরুদ্ধে মেয়র পদে লড়তে প্রস্তুত হচ্ছেন তৈমুর।
নির্বাচনের জন্য মরিয়া তৈমুরের আচরণে হতাশ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে নেতাকর্মীদের মাঝে একটি সন্দেহ গত কয়েকদিন যাবত থানা বাঁধতে শুরু করে আর তা হচ্ছে, অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারের ছোট ভাই সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদকে নির্বাচনে বিজয়ী করতে একটি প্রভাবশালী পরিবারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন তৈমুর, যেটা বরাবর নির্বাচন এলেই তিনি করে থাকেন। এবার সেই পরিবার থেকে শর্ত দেয়া হয়েছে ছোট ভাইকে পাস করাতে হলে তৈমুরকে মেয়র পদে নির্বাচন করতে হবে। ছোট ভাইকে বিজয়ী করতে এবার নিজে কোরবানি হচ্ছেন তৈমুর আর দলের সাথে করছেন বেইমানি- এমনটাই জানা গেছে বিএনপির তৃনমূল নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে।
নেতাকর্মীদের মাঝে চলমান এই গুঞ্জনের কারণ হিসেবে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ চরম বেকায়দায় ছিলেন। করোনাকালীন সময়ে মানবতার ফেরিওয়ালা সাজার জন্য তার ফটোসেশনের গোমর ফাঁস হয়ে গেছে। সেই সাথে বর্তমানে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আর ধর্ষন মামলার আসামি হয়ে ভোটারদের কাছে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তাই খোরশেদকে নির্বাচনে বিজয়ী করতে তার বড় ভাই অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার দলের সাথে এই চরম বেঈমানি করছেন বলে মনে করেন নেতাকর্মীরা।
নেতাকর্মীদের সেই ধারণা সত্যে পরিণত হতে দেরি লাগে নি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদপ্রার্থী মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল হোসেন লোকচক্ষুর অন্তরালে গিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। রবিউলের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর থেকে চাপা গুঞ্জন সত্যে পরিণত হয়। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বুঝতে বাকি থাকে না কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়াচ্ছে। কারণ কোনো উপর মহলের নির্দেশ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল হোসেন মাঠ ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না। আর সেই উপরমহলের ঘনিষ্ঠজন এখন মেয়র প্রার্থী তৈমুর। যিনি নিজের ভাইকে কাউন্সিলর নির্বাচিত করতে সেই উপর মহলের শরণাপন্ন হয়েছেন। আর সেই উপরমহলের ইশারায় তৈমুর আলম খন্দকারের ছোট ভাই মাকসুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের জয়ের পথ মসৃণ করতে রবিউল হোসেন কে সে পথ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে মনে করেন সচেতন নারায়ণগঞ্জবাসী।