নারায়ণগঞ্জ মেইল: নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা সেলিনা হায়াত আইভীর বিরুদ্ধে অবৈধ দখলের অভিযোগ ক্রমেই লম্বা হচ্ছে। রাজউকের জায়গা দখল করে মাইক্রো ও ট্যাক্সি স্ট্যান্ড বানানো, রেলওয়ের জায়গা দখল করে পার্ক নির্মাণ, মসজিদ ও মন্দিরের জায়গা দখল এবং সর্বশেষ এক আইনজীবীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি জোর করে দখলের অভিযোগ উঠেছে সিটি মেয়র আইভী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে। বারবার দখল বিতর্কে জড়িয়ে সমালোচনার ঝড় তুলছেন নাসিক মেয়র আইভী।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভীর বিরুদ্ধে দখলের অভিযোগ বহু পুরনো। ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া বালুর মাঠে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের দখলে থাকা প্রায় ৪৮ কাঠা জমি উদ্ধার করে রাজউক। জমির উপর ট্যাক্সি ও মাইক্রোবাস স্ট্যান্ডসহ অন্তত অর্ধশত স্থাপনা ছিল।
ঐদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজউকের একটি উচ্ছেদকারী দল এসব স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়। পরে সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দেয় রাজউক।
উচ্ছেদ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জামাল আকতার ও ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী। ওই সময়ে রাজউকের যুগ্ম সচিব দুলাল কৃষ্ণ সাহা, যুগ্ম সচিব ও রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) মোহাম্মদ আব্দুল হাই, রাজউকের নারায়ণগঞ্জ জোনের কর্মকর্তা আশিষ কুমার সাহা, নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়াসহ বিপুল সংখ্যক পুলিশ উপস্থিত ছিলেন।
আশিষ কুমার সাহা উচ্ছেদ এর বিষয়ে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, গত রোববার তিনি রাজউকের জমি দখল করে রাখা ব্যক্তিদের নোটিশ দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যেও তারা সরে না যাওয়ায় বৃহস্পতিবার উচ্ছেদ করা হয়েছে।
রাজউকের সদস্য আবদুল হাই বলেছিলেন, জায়গাটিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন অবৈধভাবে এ জমিতে ট্যাক্সি ও মাইক্রো স্ট্যান্ড ইজারা দিয়েছে। এ জমি নিয়ে কোনো ধরনের মামলা কিংবা ঝামেলা নেই।
নারায়ণগঞ্জ জেলা মাইক্রোবাস ও ট্যাক্সি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেছিলেন, তাদের ছয় শতাধিক গাড়ি রয়েছে। আমরা সিটি কর্পোরেশনকে আট লাখ টাকা দিয়ে ইজারা নিয়েছি। কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের বিনা নোটিশে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
এরপর ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে ৩২টি বাসা ও বাড়ী ভেঙে অবৈধভাবে ১৬ একর জায়গা দখল করার অভিযোগ উঠে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে। সেই সাথে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্তের কথা উল্লেখ করে পৃথক দুটি মামলা হয় সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দায়েরকৃত ওই মামলা দুটিতে আসামী করা হয়েছিলো এনসিসি‘র সার্ভেয়ার কালাম মোল্লা, আইন কর্মকর্তা জিএম সাত্তার, পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আলমগীর হিরণসহ অজ্ঞাত ৫০/৬০ জনকে।
রেল কর্তৃপক্ষের দাবি ছিলো, বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় ৭০ বছরের পুরানো স্টাফ কোয়ার্টার ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে প্রায় ১৬ একর জায়গা দখল করে নিয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন। দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী কোন সরকারী সম্পত্তি অন্য কোন সরকারী বা বেসরকারী সংস্থা সংশ্লিষ্ট মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কাছে লিখিত অনুমতি সাপেক্ষেই কেবল লিজ বা দখলভোগ করতে পারে। এক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এ জমি অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে। এমনকি রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দখলে বাধা দিতে গেলে তাদের উপর এক্সাভেটর (ভেকু) তুলে দিয়ে চাপা দেয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে। কোন প্রকার নোটিশ ছাড়াই গত ৫ অক্টোবর ৩২টি বাসা ও বাড়ী ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
এব্যাপারে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবী করে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা ও ঢাকা কমলাপুর রেলওয়ে থানায় পৃথক দুটি মামলা করেছিলো রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। মামলার এজাহারে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ অবশিষ্ট কোয়ার্টারগুলোও ভাঙ্গার পায়তারা করছে বলে আশংকা করা হয়। দখলকারী বহিরাগতরা নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীর কর্মী বলে রেল কর্মকর্তারা দাবী করছেন।
নারায়ণগঞ্জের দেওভোগের ঐতিহ্যবাহী জিউস পুকুর ও লক্ষীনারায়ণ আখড়া মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তি দখলের অভিযোগ ওঠে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে। মন্দিরের সম্পত্তি রক্ষার দাবিতে ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে প্রথমবারের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি পালন করে জেলা ও মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদ। কর্মসূচি শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন সংগঠনটির নেতারা। পরবর্তীতে একই দাবিতে ২ ডিসেম্বর নগরীর চাষাড়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পালন করা হয় প্রতীকী অনশন। এ অনশনে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা অংশ নেন এবং এ দাবির প্রতি সংহতি জানান। এছাড়াও জিউস পুকুরপাড়ে হাজার হাজার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করে সম্পত্তি উদ্ধারের দাবি জানায়।
এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ শহরের ঐতিহ্যবাহী ৫৩৯ বছরের পুরাতন মণ্ডলপাড়া জামে মসজিদের ওয়াকফ এস্টেটের প্রায় ৮৩ শতাংশ জায়গায় স্থাপনা ভাঙচুর, দখলের চেষ্টা ও অবৈধভাবে বাণিজ্যিক করণের মাধ্যমে পার্ক ও মার্কেট নির্মাণে দীর্ঘদিন ধরে অপচেষ্টা করছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী- এরকম একটা অভিযোগ পাওয়া যায় মসজিদ কমিটির কাছ থেকে।
এ বিষয়ে আদালতে মামলা দায়ের করলে মসজিদের জমির ওপর আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আদেশ নিয়েছেন বলে জানায় মসজিদ কমিটি এবং এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনও করেন তারা।
সর্বশেষ গত ২৪ জুন নারায়ণগঞ্জে সিটি করপোরেশনের সহযোগিতায় আইনজীবীর জমি দখল ও বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠে মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা উজ্জলের বিরুদ্ধে। উজ্জল সিটি মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীর আপন ছোট ভাই।
অভিযোগে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) সকাল থেকে সিটি করপোরেশনের সার্ভেয়ার কামাল মোল্লার উপস্থিতিতে করপোরেশনের ভেকু দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীর টিনশেড বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। দখলকালে যুবলীগ নেতার দেড় শতাধিক সমর্থক ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। ফতুল্লা থানা পুলিশকে খবর দিলেও কোনো সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী আইনজীবী মোস্তাক আহমেদ।