ভালো নেই গার্মেন্টস শ্রমিকরা, রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

নারায়ণগঞ্জ মেইল: আজ মহান মে দিবস। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছে করোনা মহামারি। এ সময়টায় মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা দেখা গেলেও ভালো নেই পোশাক শ্রমিকরা। স্বাস্থ্যঝুঁকি মাথায় নিয়েই চালিয়ে যাচ্ছেন কারখানার চাকা।

গতবছর মহামারিতে তৈরি পোশাক খাতে চাকরি হারিয়েছেন তিন লাখ ৫৭ হাজার শ্রমিক। অনেক কারখানা বন্ধও হয়েছিল। যারা চাকরিতে টিকেছিলেন তারাও ঠিকমতো বেতন পাননি। একবছরে দেশের ৩৫ শতাংশ পোশাক শ্রমিকের বেতন কমেছে। যদিও এ সময় বেড়েছে যাবতীয় নিত্যপণ্যের দাম।

শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা আহসান হাবীব বুলবুল বলেন, এখন পর্যন্ত কোনও শ্রমিকের বেতন বাড়েনি। জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে ঠিকই। তাই ৩৫ শতাংশের সঙ্গে প্রকৃত মজুরি আরও ১৫ শতাংশ কমেছে। সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকি তো আছেই।

সংক্রমণের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি উপেক্ষা করে কাজ করলেও যথাযথ পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। ‘দি উইকেস্ট লিঙ্ক ইন গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন: হাউ দ্য প্যানডেমিক ইজ অ্যাফেক্টিং বাংলাদেশ গামেন্টস ওয়ার্কার্স’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) এক ভার্চুয়াল আলোচনাসভায় এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। ইউএনডিপি ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ‘চৌধুরী সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ’ এবং ‘ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড বিজনেস’ পরিচালিত এই গবেষণায় করোনাকালীন গামেন্ট কর্মী, বিশেষ করে নারী কর্মীদের বিভিন্ন ঝুঁকির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, গতবছর করোনা শুরুর পর দেশের ৩৫ শতাংশ পোশাক শ্রমিকের বেতন কমানো হয়েছে। এ ছাড়া বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া, শিপমেন্টে দেরি হওয়া, সময়মতো পণ্যের মূল্য না পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে পোশাকখাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এতে আরও বলা হয়, করোনার অজুহাতে নারী শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বেশি। অনেকের বেতন কমানো হয়েছে। বাধ্য হয়ে কর্মীরা ধার-দেনায় জড়িয়েছেন।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্প ম্যাপড ইন বাংলাদেশ’র (এমআইবি) সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ৫০ শতাংশের বেশি কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে। কোভিড মহামারি বিবেচনায় আরএমজি খাতে ক্ষতি, ক্ষমতা এবং পুনরুদ্ধার: মাঠ জরিপ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল’ শীর্ষক সমীক্ষাটি গত জানুয়ারিতে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, সংকট এতোটাই মারাত্মক যে, মাত্র ৪৪ শতাংশ কারখানা ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসের অর্ডার নিশ্চিত করতে পেরেছে।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৫৬ শতাংশ কারখানা বিভিন্ন স্তরে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এবং ১১ শতাংশ কারখানা ‘অনেক বেশি’ অনিশ্চয়তায় আছে।

এমআইবি’র তিন হাজার ২১১টি নথিভুক্ত কারখানার মধ্যে ৬১০টি কারখানার ওপর এ জরিপ চালানো হয়।

প্রাথমিক জরিপটি ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের চারটি বৃহৎ শিল্প এলাকায় ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে পরিচালিত হয়েছিল।

গতবছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় ২৫ লাখ ৬২ হাজার ৩৮৩ কর্মীর মধ্যে প্রায় তিন লাখ ৫৭ হাজার ৪৫০ জনের মতো চাকরি হারিয়েছেন। যা মোট শ্রমিকের প্রায় ১৪ শতাংশ।

সিপিডি আরও জানায়, কর্মী ছাঁটাই ও কারখানা বন্ধের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মালিকই নিয়ম মানেননি। মাত্র তিন দশমিক ছয় শতাংশ কারখানা ক্ষতিপূরণের নীতি মেনেছে। তারা বেতন ও ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এবং বকেয়া পরিশোধ করেছে। বেতন দিয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ কারখানা।

মহামারির কারণে অনেক কারখানা ছোট হয়ে গেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে একটি কারখানায় শ্রমিকের গড় সংখ্যা ছিল ৮৮৬। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে তা ৭৯০ জনে নেমে এসেছে।

এদিকে ‘গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠনের শীর্ষনেতারা এক বিবৃতিতে বলেছেন করোনার কারণে এবছর শ্রমিকরা বিগত বছরের মতো মহান মে দিবসও উদযাপন করতে পারছে না। অথচ লকডাউন চলাকালীন গার্মেন্ট শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কারখানায় কাজ করতে হচ্ছে। অধিকাংশ কর্মস্থলে স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারি নির্দেশনা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না।

নেতারা বলেন, আমরা দেখছি, মে দিবসের ইতিহাস রচিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে তখনকার শ্রমিক শ্রেণির দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণার যে চিত্র প্রতীয়মান হয়েছিল, আজকের প্রেক্ষাপটেও সেই একই শোষণ-পীড়নে অতিষ্ঠ শ্রমিকরা।’

বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘মহান মে দিবসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের অধিকার অর্জিত হওয়ার পরেও তা আমাদের দেশে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এখনও গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদেরকে নানা অজুহাতে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করানো হয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, আমরা প্রতিযোগিতায় কোনও মতে টিকে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কোভিড ১৯-এ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর পোশাক খাত যে মুহূর্তে একটু উঠে দাঁড়াচ্ছিল, তখনই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। এই সময়ে সুতা ও তুলার মতো কাঁচামালের দাম বাড়লেও তৈরি পোশাকের দাম বাড়েনি, বরং ১৫ শতাংশ কমেছে।

তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ কারখানার মালিক আর্থিক সংকটে থাকার পরও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে শ্রমিকদের স্বার্থ দেখার। ব্যাংক থেকে ঋণ করে ও সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, অর্ডার আসতে থাকায় চাকরি হারানো শ্রমিকদের আবার নিয়োগ দিতে শুরু করেছি। বাস্তবতা হলো গার্মেন্টস মালিকরা আর্থিক সংকটে ভুগছে। ৮০ শতাংশ কারখানা লোকসানে চলছে।

সিপিডি সমীক্ষাতেও বলা হয়েছে, যেসব কারখানায় নতুন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগই আগে ছাঁটাইকৃত কর্মী।

  1. সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

নারায়ণগঞ্জ মেইলে এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

সর্বশেষ