প্রার্থী তালিকায় ওসমান পরিবারের পুনর্বাসন

নারায়ণগঞ্জ মেইল: আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কুখ্যাত ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ লোকজন। ইতিমধ্যেই ওসমান পরিবারের দুই দুর্ধর্ষ গডফাদার শামীম ওসমান এবং সেলিম ওসমানের আস্থাভাজন দুইজনকে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়া দিপু এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে গডফাদার সেলিম ওসমানের আস্থাভাজন মাসুদুজ্জামান মাসুদ ওরফে মডেল মাসুদকে।

এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ওসমান পরিবারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জের কিং মেকার হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আলী এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন ওসমান পরিবারের আরেক ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেন।

স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের আমলে গডফাদার ওসমান পরিবারের সাথে আঁতাত করে চলা এসকল বহুরূপী লোকদের নির্বাচনী মাঠে মেনে নিতে পারছেন না সাধারণ ভোটাররা। কারণ নারায়ণগঞ্জের মানুষ ওসমান পরিবারের বীভৎস রূপ দেখেছে। তারা দেখেছে খুন-গুম আর নির্যাতন। তাই ওসমান পরিবারের সাথে সম্পর্কযুক্ত কাউকে নারায়ণগঞ্জের মানুষ কখনো গ্রহণ করবে না।

নারায়ণগঞ্জের সচেতন ভোটাররা মনে করেন বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে আওয়ামী লীগকে মুছে ফেলতে হবে। সন্ত্রাসের জন্মদাতা ওসমান পরিবারকে মুছে ফেলতে হবে। তা না হলে নারায়ণগঞ্জ আবারো সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হবে। ৫ আগস্টের পর দুর্ধর্ষ ওসমান পরিবার পালিয়ে গেলেও বিদেশে বসে বিভিন্ন নাশকতার চক্রান্ত করছে। আর এসব চক্রান্তে তাদেরকে সহায়তা করছে বাংলাদেশে থাকা ওসমান পরিবারের দোসররা। তাই এদেরকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। বিশেষ করে নির্বাচনী মাঠে স্বৈরাচারের কোনো দোসরকে রাখা যাবে না। কারণ এরা নির্বাচিত হয়ে এলে নারায়ণগঞ্জ আবার ওসমান পরিবারের নিয়ন্ত্রনে চলে যাবে। যা কোনদিনও হতে দেয়া যাবে না।

নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির কথিত কিং মেকার ও সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ আলী ছিলেন ওসমান পরিবারের ঘনিষ্টজনদের মধ্যে অন্যতম। প্রয়াত নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে সেলিম ওসমান নির্বাচনে অংশ নিলে প্রথমে সেলিম ওসমানের পক্ষে ভোট চেয়ে ওসমানীয় সম্রাজ্যে যোগ দেন। এরপর থেকে ওসমান পরিবারের সাথে আওয়ামীলীগের বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নেন।

মোহাম্মদ আলী নিজের রাজত্ব ধরে রাখতে সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী ও ওসমান পরিবার উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক রাখতেন। ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর ওসমান পরিবার পালিয়ে গেলেও তাদের বিভিন্ন সেক্টর নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা চালিয়ে যান মোহাম্মদ আলী। তার ভাতিজা ও ভাগ্নেরা দখলবাজী শুরু করেন ফতুল্লার বিভিন্ন এলাকায়। তবে ২৪ মার্চ দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে অনুদান বিতরণ অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে তোপের মুখে পড়েন মোহাম্মদ আলী। দীর্ঘদিনে অভ্যাসের কারণে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন তিনি। এই ব্যক্তব্যকে কেন্দ্র করে মোহাম্মদ আলীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রতিরোধের ঘোষণা দেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপুসহ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দরা। পরবর্তিতে সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষমা চান মোহাম্মদ আলী।

নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের আরেক সহযোগী হলেন মডেল গ্রুপের কর্ণধার মাসুদুজ্জামান মাসুদ। সেলিম ওসমানের একান্তর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে প্রায়ই তাকে মঞ্চে দেখা যেতো। নারায়ণগঞ্জ বিএনপিতে দীর্ঘদিন যারা রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে তাদেরকে হতাশ করে দিয়ে ৫ আগস্টের পর থেকে শিল্পপতি মাসুদুজ্জামান মাসুদ ওরফে মডেল মাসুদ নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষের মনোনয়ন চাইছেন। এ লক্ষ্যে তিনি ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অতি সম্প্রতি তিনি বিশাল আয়োজন করে ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে বিএনপিতে যোগদান করেন যা দেখে তৃণমূল নেতাকর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

তৃণমূল মনে করে বিএনপির গত ১৭ বছরের আন্দোলন সংগ্রামে একদিনের জন্যও রাজপথে দেখা যায়নি মডেল মাসুদকে। বরং সে সময়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এমপিদের সভা সমাবেশে প্রায়ই দেখা মিলেছে তার। দুঃসময়ের আন্দোলন সংগ্রামে যখন সারা দেশে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছে তখন মাসুদুজ্জামান মাসুদ পুরোপুরি ব্যবসায়ী মেজাজে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সমান তালে ব্যবসা করেছেন, কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

গত ১৫ বছরে সরকার বিরোধী আন্দোলনের মিটিং মিছিলে একবারের জন্যও দেখা মিলেনি মডেল মাসুদের। সারাদেশে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা সরকারের মামলা হামলায় জর্জরিত হলেও মডেল মাসুদকে কোনদিন পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ বিরক্ত করেনি। দলের দুঃসময় কেটে যাওয়ায় মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন এই ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগের আমলে কামানো কোটি কোটি টাকা নিয়ে নেমে পড়েছেন মনোনয়ন কেনার প্রতিযোগিতায়।

শামীম ওসমান আত্মগোপনে যাওয়ার আগে সর্বশেষ যে বাড়িতে অবস্থান নিয়েছিলেন সেই বাড়িটি মালিক ছিলেন দিপু ভূইয়া। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শামীম ওসমানের পারিবারিক বিশ্বস্ত একজন। যার কল রেকর্ড সংগ্রহ রয়েছে এই প্রতিবেদকের কাছে। শামীম ওসমানের পারিবারিক বিশ্বস্ত ব্যক্তি জানান, গুলশানে মালিকানাধীন গাউসিয়া ভবনে শামীম ওসমানকে একটি ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছিলেন দিপু ভূইয়া। গত ১৯ জুলাই শামীম ওসমান ও অয়ন ওসমান ছাত্র জনতার উপর গুলি বর্ষন শেষে ঢাকা গাউসিয়া ভবনে অবস্থান নেন। সেই সময় শামীম ওসমান পালিয়ে গেছে এমন একটি গুজব ছড়িয়ে পড়লে ওয়ন ওসমান ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় নিশ্চিত করেন তারা এখনো বাংলাদেশেই আছেন। যে বাড়ি থেকে ভিডিও বার্তা দেয়া হয়েছিলো সেটি দিপু ভূইয়ার বাড়ি ছিল।

গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও শামীম ওসমান ও তার ছেলে অয়ন ওসমান আত্মগোপনে চলে যান। গুলশানের বাড়িতে আটকা পরেন লিপি ওসমানসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। ঐ দিন তাণ্ডবে সকাল সাড়ে ১০টায় পারিবারিক বন্ধু বিএনপি নেতা দিপু ভূঁইয়া ওসমান পরিবারের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। রাত ১১ টায় দিপু ভূঁইয়া নিজেই কালো গ্লাস ঘেরা গাড়িতে করে লিপি ওসমান, তার মেয়ে লাবিবা জোহা অঙ্গনা, অয়নের স্ত্রী ইরফানা আহমদ রাশমী ও অয়নের শিশু সন্তানকে নিয়ে রওনা দেন সিলেটের উদ্দেশ্যে। ওসমান পরিবারকে পালিয়ে যেতে সহযোগীতা করার পাশিপাশি বর্তমানে শামীম ওসমানের বেনামে সকল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন দিপু ভূইয়া।

ওসমান পরিবারের আরেক ঘনিষ্ট ব্যক্তি বন্দর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেন। জেলা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি মাকসুদ দীর্ঘদিন সেলিম ওসমানের রাজনীতি করেছেন। ওসমান পরিবারের নাম ভাঙ্গিয়ে বন্দর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তিনি। মাকসুদের রয়েছে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। এদেরকে ব্যবহার করে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে ভূমিদস্যুতা- এমন কোনো অপরাধ নেই যা এই মাকসুদ চেয়ারম্যান করেননি। সেই মাকসুদ এবার এমপি নির্বাচন করার স্বপ্ন দেখছেন।

নারায়ণগঞ্জ মেইলে এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

সর্বশেষ