নারায়ণগঞ্জ মেইল: আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিগত ১৫ বছর এই দলটির নেতাকর্মীরা স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন আর হামলা মামলা জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাই নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে বিগত দিনের আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় আর ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়নের দাবি এখন সর্বত্র। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক এই নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল করা হলে এর কড়া মাশুল গুনতে হতে পারে বলে আশঙ্কা তৃণমূলের। বিশেষ করে বিগত আন্দোলন সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দেওয়া হলে জয়ের বদলে পরাজয়ের সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করছেন তারা। তাই এবারে নির্বাচনে ত্যাগী নেতাদের মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানিয়েছে তৃণমূল।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি রাজনৈতিক আসন হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর-বন্দর)। এই দুটি আসনে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষের মনোনয়নের জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে তারা সক্রিয় হয়েছেন এবং কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত তৃণমূল পর্যন্ত টাকা ছিটিয়ে দলীয় মনোনয়ন আনার চেষ্টা করছেন যা কোনভাবেই ভালো চোখে দেখছে না বিএনপির মাঠ পর্যায়ের কর্মী সমর্থকরা। বিগত ১৫ বছর বিপদ আপদে যাদেরকে কাছে পায়নি তাদেরকে জন প্রতিনিধি হিসেবে তৃণমূল মেনে নেবে না বলেও হুঁশিয়ারি জানিয়েছেন।
মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধান বলছে, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনটি গত ১৫ বছর ছিল গডফাদার শামীম ওসমানের দখলে। এই খুনি সন্ত্রাসীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছিলেন সাবেক এমপি মোঃ গিয়াসউদ্দিন। গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জের বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা রাজপথে সরকার বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামী ছিলেন সক্রিয়। তাছাড়া নেতাকর্মীদের বিপদে আপদে ও মামলা মোকদ্দমায় সব সময় পাশে ছিলেন সাবেক এই সংসদ সদস্য। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়েও তিনি তার রাজনৈতিক দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সাংগঠনিক কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছেন।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ফতুল্লার ব্যবসায়ী মোঃ শাহ আলম। যিনি বিগত সময়ে কল্যাণ পার্টির নেতা ছিলেন। সেখান থেকে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে এই আসনেই নির্বাচন করেছিলেন কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় না আসায় আর রাজনৈতিক মাঠে তাকে দেখা যায়নি। এমনকি ঘোষণা দিয়ে বিএনপির সকল পদ পদবী থেকে পদত্যাগ করেছিলেন শাহ আলম।
দুঃসময়ের আন্দোলন সংগ্রামে যখন সারা দেশে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছে তখন শাহ আলম পুরোপুরি ব্যবসায়ী মেজাজে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সমান তালে ব্যবসা করেছেন, কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। গত ১৫ বছরে সরকার বিরোধী আন্দোলনের মিটিং মিছিলে একবারের জন্যও দেখা মিলেনি শাহ আলমের। সারাদেশে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা সরকারের মামলা হামলায় জর্জরিত হলেও শাহ আলমকে কোনদিন পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ বিরক্ত করেনি। দলের দুঃসময় কেটে যাওয়ায় আবারো মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন এই ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগের আমলে কামানো কোটি কোটি টাকা নিয়ে নেমে পড়েছেন মনোনয়ন কেনার প্রতিযোগিতায়।
তবে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিগত দিনে যারা রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদেরকেই দলীয় মনোনয়ন দিতে হবে। যারা আওয়ামী লীগ আমলে মামলা হামলা খায়নি, আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে মিলেমিশে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন আর মোটা টাকার মালিক হয়েছেন, তাদেরকে মনোনয়ন দেয়া হলে তারা মানবেন না। এবারের দলীয় মনোনয়ন যাতে টাকায় বিক্রি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে দলের হাই কমান্ডের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এই এলাকার তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
নারায়ণগঞ্জের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আসন হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ-৫ যা সদর এবং বন্দর থানা নিয়ে গঠিত। এই এলাকায় গত ১৫ বছর বিএনপি’র হাল ধরে আছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথের প্রতিটি কর্মসূচিতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি আইনাঙ্গনে বিএনপির নেতাকর্মীদের জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন নিরন্তর। এজন্য অসংখ্য মিথ্যা মামলার আসামি হয়েছেন, বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে থেকেছেন, জেলও খেটেছেন বহুবার। তবুও রাজপথ ছেড়ে যাননি, শহীদ জিয়ার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। গত ১৫ বছরে সুস্থ রাজনীতির আইকনে পরিণত হয়েছেন এডভোকেট সাখাওয়াত। তাই সদর-বন্দরের নেতাকর্মীরা মনে করে নারায়ণগঞ্জ৫ আসনে সাখাওয়াতের চেয়ে যোগ্য আর কেউ নেই।
তবে গুরুত্বপূর্ণ এই আসনে দুজন শিল্পপতি বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পেতে মাঠে নেমেছেন। এদের মধ্যে একজন হচ্ছে মডেল গ্রুপের কর্ণধার মাসুদুজ্জামান মাসুদ ওরফে মডেল মাসুদ এবং অপরজন হচ্ছেন প্রাইম গ্রুপের মালিক আবু জাফর বাবুল ওরফে প্রাইম বাবুল।
তৃণমূল বলছে, বিগত ১৫ বছর সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে এই দুই ব্যবসায়ীকে দেখা না গেলেও ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরপর তারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন এবং নিজেদেরকে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে দাবি করতে থাকেন তারা দুজন। স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের এমপি মন্ত্রীদের সাথে আঁতাত করে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে কামানো কোটি কোটি টাকা নিয়ে ভোটের মাঠে নেমেছেন এই দুই শিল্পপতি যাদের সাথে তৃণমূলের নেই কোন সংযোগ। নেতাকর্মীদের বিপদ-আপদে তারা কখনো এসব নামধারী নেতাদের কাছে পায়নি বরং মাঝে মাঝে গডফাদার শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের মঞ্চে তাদেরকে দেখা গেছে। তাই এসব ব্যবসায়ীদের জনপ্রতিনিধি হিসেবে মেনে নেবেন না সদর বন্দরের কর্মী সমর্থকরা। যদি ১৫ বছরের ত্যাগ তিতিক্ষা টাকার কাছে মূল্যহীন হয়ে যায় তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ দলের জন্য রাজপথে নামবে না, যা রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করেন সকলে। এ লক্ষ্যে হাই কমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তারা।