মান্নান সাম্রাজ্য পতনের নেপথ্যে …..

নারায়ণগঞ্জ মেইল: সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নানের সাম্রাজ্যে এবার পতনের ঘন্টা বাজছে। যোগ্য আর ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন, ৫ আগস্টের পর সীমাহীন চাঁদাবাজি আর দখলদারিত্ব, কর্মচারী আর চাকর বাকর শ্রেণীর লোকদের দিয়ে কমিটি সাজানো, দলের নিবেদিত প্রাণ নেতাকর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার আর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে মান্নান ও তার ছেলে সজীবের গড়ে তোলা সাম্রাজ্য আজ হুমকির মুখে। তাছাড়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মামলায় বাপ-বেটা ও তাদের পিএস সেলিমের সীমাহীন বাণিজ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সোনারগাঁযর সাধারণ মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। সেই সাথে গিয়াসউদ্দিনের মত হেভিওয়েট নেতা সোনারগাঁয়ে দৃষ্টি ফেরানোতে মান্নান ও তার পুত্র সজীব চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অতি সম্প্রতি সোনারগাঁয়ে একটি অনুষ্ঠানে সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ সভাপতি নজরুল ইসলাম টিটুর সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেন আজহারুল ইসলাম মান্নান। এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মান্নানের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে পুরো সোনারগাঁ। নজরুল ইসলাম টিটু পারিবারিকভাবে সোনারগাঁয়ে বেশ জনপ্রিয়। তার সাথে মান্নানের এই অশালীন আচরণ মেনে নিতে পারেনি সোনারগাঁয়ের সাধারণ মানুষ।

তাছাড়া দেশব্যাপী চলমান বিএনপির সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সোনারগাঁয়ে নিজ বলয়ের নেতাকর্মীদের সদস্য সংগ্রহ ও নবায়নের ফরম দিচ্ছেন মান্নান। বাকিদের ফর্ম না দিয়েই বিদেশে চলে গেছেন তিনি। এ নিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ নিয়ে তারা বিএনপির হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সেই সাথে আদালতে মামলা করার হুঁশিয়ারিও জানিয়েছেন।

মান্নান সাম্রাজ্য পতনের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় কারিগর হচ্ছে তার পিএস হিসেবে পরিচিত সেলিম। এই সেলিমের একের পর এক বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে মান্নানের জনপ্রিয়তা শূন্যে এসে ঠেকেছে। মামলা বাণিজ্য, অসহায় মানুষের জায়গা সম্পত্তি দখল, টাকার বিনিময়ে কমিটিতে পদ পদবী দেওয়া থেকে শুরু করে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা এই সেলিম করেনি। যার প্রভাব পড়েছে মান্নানের উপরেও। এই সেলিমকে অতিরিক্ত প্রশ্রয়ের মাশুল গুনতে হচ্ছে মান্নান ও তার ছেলেকে।

এদিকে মান্নান তার ছেলে জেলা যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক খায়রুল ইসলাম সজিব ও তাদের লোকজন উপজেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৩৮টি শিল্প-কারখানায় দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ঝুট, স্ক্রাবসহ বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে নিজ দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে উপজেলার সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকের দাবি, এখনই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা মান্নানের এহেন কর্মকাণ্ডের লাগাম টেনে না ধরলে আগামী সংসদ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে। তবে মান্নানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করেন। একটি পক্ষ তার বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা গা-ঢাকা দেন। এই সুযোগে আজহারুল ইসলাম মান্নান, ছেলে সজিব ও তার সহযোগীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন লোকজনের বাড়িঘরে হামলা, পিরোজপুর ইউপির সাবেক মহিলা সদস্য মমতাজ বেগমকে তার বাড়ি থেকে জোরপূর্বক বের করে দেয়া, সোনারগাঁও সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আশরাফুজ্জামান অপু ও সহকারী অধ্যাপক খন্দকার দিল আফরোজকে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেয়াসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।

এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় থানায় দায়েরকৃত মামলায় আসামি করার হুমকি দিয়ে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন মান্নান ও তার লোকজন। তাছাড়া মামলা করার পর বাদীকে দিয়ে আদালতের মাধ্যমে আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার কথা বলে আরেক দফা অর্থ হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আরও অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় সোনারগাঁও থানায় যে ৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে তা সম্পূর্ন উদ্দেশ্য প্রনোদিত। উল্লেখিত মামলা গুলোর প্রকৃত ঘটনাস্থল ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জের মাদানীনগর ও রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকা। অথচ হতাহতের পবিবারের লোকাজনকে টাকা দিয়ে ঘটনাস্থল সোনারগাঁও দেখিয়ে মামলা দায়ের করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। উল্লেখিত মামলার প্রত্যেকটিতে শেখ হাসিনাকে প্রধান করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সাধারণ ব্যবসায়ী ও দিনমজুর লোকজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৪ হাজার সাধারণ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। 

এতে মান্নান ও তার লোকজন ক্ষান্ত না হয়ে লাঠি- সোঠা নিয়ে মিছিলের মাধ্যমে প্রথমে এলাকায় আতংক সৃষ্টি করে। একই সাথে মামলায় আসামি করে তাদের ঘরবাড়ি দখল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল, শিল্প কারখানার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রনে নেয় মান্নান পুত্র খাইরুল ইসলাম সজীব। অন্যদিকে মান্নানের নির্দেশে উপজেলার পিরোজপুর এলাকায় নীরহ মানুষের জমি দখল করে নিচ্ছে মান্নানপন্থী বিএনপি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুর রহমান কসাই ও সেলিম হোসেন দীপুসহ তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী। তাছাড়া সম্প্রতি চাঁদাবাজীর অভিযোগে যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন মোগরাপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান।

এদিকে থানায় দায়েরকৃত মামলার বাদিরা জানেন না তাদের মামলায় কাদেরকে আসামি করা হয়েছে। এরকম ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে বাদীর সরল স্বীকারোক্তি ভাইরাল হতে দেখা গেছে। এনিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রীয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে আজহারুল ইসলাম মান্নান নিজের দুঃশাসনের রাজত্ব ধরে রাখতে নিজ দলের কর্মী-সমর্থকদেরও কোনো কোনো মামলায় আসামি করেছেন। এনিয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীদের তার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করতেও দেখা গেছে। তাছাড়া কয়েক কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে আদালতের মাধ্যমে বাদিকে মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সজিব পদত্যাগ পত্র রিসিভ করেছে, ভিডিও রয়েছে এরই মধ্যে মান্নান ও তার ছেলে সজিবের বিতর্কিত কর্মকান্ডে সোনারগাঁও উপজেলা বিএনপি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রেজাউল করিম তার সমর্থিত নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে এলাকায় বিএনপির সমর্থন আদায়ে কাজ করতে দেখা গেছে। জানা যায়, আজহারুল ইসলাম মান্নান এক সময় অধ্যাপক রেজাউল করিমের রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। পেশায় ছিলেন সাধারণ দিনমজুর। পরবর্তীতে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের দালালি করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান মান্নান। এর পর আর তাকে পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি।

এদিকে গত ৭ আগস্ট মান্নানের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী পিরোজপুর ইউপি’র প্রতাবেরচর এলাকায় সাবেক মহিলা সদস্য মমতাজ বেগম ও তার পরিবারের লোকজনকে জোরপূর্বক বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে দখলে নেয়। এ ব্যাপারে মমতাজ বেগম উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার না পেয়ে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে অভিযোগ করেন। তাছাড়া মান্নান পুত্র খাইরুল ইসলাম সজীবের বিরুদ্ধে নৌ চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রনের অভিযোগ রয়েছে। মেঘনা নদীর উপজেলার নুনেরটেক থেকে চর কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে তার লোকজন নিয়মিত চাঁদা উত্তোলন করে আসছে বলে জানা গেছে।

বিএনপি নেতা মান্নান, ছেলে খাইরুল ইসলাম সজিব ও তাদের বাহিনী এলাকার জনসাধারণের কাছে যেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। তার বাহিনী প্রতাবেরচর গ্রামের মিন্টু, ঝাউচর গ্রামের আল আমিনের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট করেছে অভিযোগ রয়েছে। তাদের ভয়ে প্রতাবেরচর, ঝাউচর ও আষাড়িয়ারচর গ্রামের ব্যবসায়ীরা এখন এলাকা ছাড়া। 

শুধু তাই নয়, মেঘনা গ্রুপের ৩টি ইকোনমিক জোনসহ ৩৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়েছে বিএনপি নেতা আজহারুল ইসলাম মান্নান, ছেলে সজিব ও ভাই হান্নানসহ তাদের সহযোগিরা। গত ৫ আগষ্টের পর মান্নানের নেতৃত্বে শতাধিক লোকজন নিয়ে ফ্রেশ সিমেন্ট, ফ্রেশ ফিড, ফ্রেশ ডালডা, ফ্রেশ ফাইবার, ফ্রেশ চা, ফ্রেশ সুগার, ফ্রেশ বলপেন, মেঘনা সিরামিকস, মেঘনা পাল্প পেপার,  মেঘনাঘাট ৪৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট, মেঘনাঘাট সামিট ৩০৫/৩৩৭ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট-১, মেঘনাঘাট সামিট ৭৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট-২, অরিয়ন পাওয়ার প্লান্ট, মেঘনাঘাট স্যামসাং ৭১৮ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট, হাজি সেলিম ডকইয়ার্ড, বাংলা ডকইয়ার্ড, আল মোস্তফা গ্রæপ, চায়না ব্যাটারি ও আনন্দ শীপইয়ার্ডে গিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান তার দখলে নেয়। 

এছাড়া মান্নানের নির্দেশে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের প্রথমে হত্যা মামলার আসামি করা হয়। পরে তাদের ইউপি চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিত থাকার সুযোগে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে মান্নানের পছন্দের জনপ্রতিনিধিদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে সুপারিশ করেন। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী ও বিএনপি ঘরানার একাধিক নেতার সাথে কথা বললে তারা সোনারগাঁও উপজেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মান্নান ও তার ছেলে সজিব এবং তাদের সহযোগিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে জোর দাবী জানান।

এ ব্যাপারে জানতে সোনারগাঁও উপজেলা বিএনপি সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নানের সাথে যোগাযোের চেষ্টা করা হলে তিনি দেশের বাইরে থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

নারায়ণগঞ্জ মেইলে এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

সর্বশেষ