নারায়ণগঞ্জ মেইল: বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে গত দুই বছর কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন ছিলো না হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দের স্নানোৎসবের যা স্থানীয়ভাবে অষ্টমীস্নান নামে বহুল প্রচলিত। তবে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে আসায় দুই বছর পরে এবার পূর্ণ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে এই উৎসব। ৮ এপ্রিল রাত নয়টায় শুরু হয়ে ও ৯ এপ্রিল রাত এগারোটা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার অন্তর্গত লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদে অনুষ্ঠিত হয় এবারের স্নানোৎসব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শিখন সরকার শিপন জানান, মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদূর্ভাবের কারনে গত দুই বছর বাতিল করা হয়েছিলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দের পুণ্যস্নানের সকল আনুষ্ঠানিকতা। তবে এবার করোনার প্রভাব কমে আসায় ৮ ও ৯ এপ্রিল আমরা এ উৎসব আয়োজনের করেছি এবং সকলের সহযোগিতায় সফলভাবে শেষ ককরতে পেরেছি। দুই বছর পরে এ উৎসব আয়োজন হওয়ায় ভক্তবৃন্দের মাঝে বিপুল উৎসাহ উদ্দিপনা ছিলো। নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের মাননীয় সাংসদ একেএম সেলিম ওসমানের নির্দেশনায় এবং জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সার্র্বিক সহযোগিতায় আমরা সফলভাবে এবারের স্নানোৎসব সমাপ্ত করতে পেরেছি। দীর্ঘ দুই বছর পরে হওয়ায় এবার অনেক লোকের সমাগম ঘটলেও পূজা উদযাপন পরিষদ ও স্নান উৎসব উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টায় নির্বিঘ্ন ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে স্নান উুৎসব আয়োজন করতে পেরেছি। এ জন্যে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
তিনি আরো বলেন, মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র মাহে রমজান মাস চলিতেছে। রমজানের সিয়াম সাধনার পাশাপাশি হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দের পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতেই প্রমাণিত হয় সকল ধর্মের সহবস্থানে অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে, সকল ধর্মের উৎসব পালন করছে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জানা যায়, প্রতিবছর চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদে পুণ্যস্নানার্থে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্তপ্রাণের আগমন ঘটে। ভক্তগণের বিশ্বাস এ সময় ব্রহ্মপুত্র নদে স্নান খুবই পুণ্যের, এ স্নানে ব্রহ্মার সন্তুষ্টি লাভ করে পাপমোচন হয়। এই স্নানই অষ্টমী স্নান নামে অভিহিত। অধিকাংশ স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, চৈত্রের শুক্লাষ্টমীতে জগতের সকল পবিত্র স্থানের পুণ্য ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হয়। নদীর জল স্পর্শমাত্রই সকলের পাপ মোচন হয়। যে এই পবিত্র জলে স্নান করে সে চিরমোক্ষ লাভ করে।
স্নান উপলক্ষে লাঙ্গলবন্দের ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই তীর্থস্থানটি বিভিন্ন বয়সের ধর্মপ্রাণ ও পুণ্যার্থী মানুষের কলকোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে। দীর্ঘ এলাকা জুড়ে তিন-চার দিনবাপী এক বিরাট মেলা বসে। এ মেলায় লোকজ ও কারুশিল্প থেকে শুরু করে সব রকম জিনিস পাওয়া যায়। মেলায় আশপাশের অঞ্চল থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন সওদা করতে আসে।
লাঙ্গলবন্দের অষ্টমী স্নান সম্পর্কে একটি দীর্ঘ পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে। কোন এক দূর অতীতে জমদগ্নি মহামুনির রেনুকা নামে এক রাজবংশীয় পরমাসুন্দরী স্ত্রী ছিল। তাদের ছিল পাঁচ পুত্র। সর্বকনিষ্ঠের নাম ছিল পরশুরাম। ঘটনাক্রমে মার্তিকাবর্ত দেশের রাজাকে সস্ত্রীক জলবিহার করতে দেখে আশ্রমবাসিনী রেণুকা কামস্পৃহ হয়ে পড়েন এবং নিজের পূর্ব-রাজকীয় জীবন সম্পর্কে স্মৃতিবিষ্ট হন। মুনি স্ত্রীর এই আসক্তি দেখে ক্রোধান্বিত হয়ে পাঁচ পুত্রকে তাদের মাতাকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কোন পুত্রই মাতৃহত্যার মতো নিষ্ঠুর কাজ করতে রাজি হলো না। তখন মুনি তার প্রিয় পুত্র পরশুরামকে আদেশ দিলে পরশুরাম এক কুঠারের আঘাতে মাকে হত্যা করেন।
মাকে হত্যা করে পরশুরাম পরম পাপী হিসেবে চিহ্নিত হন। পাপের শাস্তি হিসেবে কুঠারটি তার হাতে আটকে থাকে। শত চেষ্টা করেও তা থেকে তিনি মুক্ত হতে পারলেন না। তখন পিতা তাকে বিভিন্ন তীর্থস্থানে গিয়ে পাপমুক্ত হতে বলেন। মাতৃহত্যার ভয়াবহ পাপের অনুশোচনা নিয়ে তিনি তীর্থ থেকে তীর্থে ঘুরে বেড়ান।
দেবতা ব্রহ্মপুত্র তখন হিমালয়ের বুকে হ্রদরূপে লুকিয়ে ছিলেন। দৈবক্রমে পরশুরাম ব্রহ্মপুত্রের মাহাত্ম্যের কথা জানতে পারেন। তিনি খুঁজে পেলেন হিমালয়ে লুক্কায়িত ব্রহ্মপুত্র হ্রদ এবং প্রার্থনা জানালেন যেন এর পবিত্র জলে তার পাপ মুক্ত হয়। তিনি হ্রদের জলে ঝাঁপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতে আটকে থাকা কুঠারখানা খসে পড়ে। এভাবে তিনি মাতৃহত্যার প্রায়শ্চিত্ত থেকে মুক্ত হলেন। ব্রহ্মপুত্রের এই অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন পাপহরণকারী জল যাতে সাধারণ মানুষের উপকারে আসে এ উদ্দেশ্যে পরশুরাম সেই জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। তিনি কুঠারখানা লাঙলের ফলকে বেঁধে সেই ফলক দিয়ে নালা সৃষ্টি করে ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ সময় ও পথ পরিক্রমায় পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে তিনি ব্রহ্মপুত্রের জলধারাকে বিভিন্ন জনপদ ঘুরিয়ে অবশেষে বর্তমান লাঙ্গলবন্দে এসে ক্লান্ত হয়ে থেমে যান এবং লাঙল চষা বন্ধ করে দেন। তার লাঙলের ফলকে তৈরি পথ ধরে ব্রহ্মপুত্র প্রবাহিত হতে থাকে। সেই থেকে এ স্থানের নাম হয় লাঙ্গলবন্দ এবং তা হয়ে ওঠে হিন্দুধর্মের মানুষের জন্য পরম পুণ্যস্থান।
এরপর পরশুরাম এ পবিত্র ব্রহ্মপুত্র নদের অলৌকিক শক্তি ও মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন তীর্থস্থান ভ্রমণে যান। কিন্তু যেখানে এসে ব্রহ্মপুত্র থেমে গেলেন তার কাছাকাছি দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের এক সুন্দরী নদী শীতলক্ষ্যা। ব্রহ্মপুত্রের কাছে সুন্দরী শীতলক্ষ্যার রূপ-যৌবনের কথা পৌঁছালে শক্তিশালী ও পবিত্র ব্রহ্মপুত্র প্রচন্ড বেগে সুন্দরী শীতলক্ষ্যার দিকে ধাবিত হলেন। ব্রহ্মপুত্রের এই ভয়ঙ্কর ও বিশাল মূর্তি দেখে সুন্দরী শীতলক্ষ্যা তার সমস্ত সৌন্দর্য আড়াল করে বৃদ্ধার রূপ গ্রহণ করেন এবং নিজেকে বুড়িগঙ্গারূপে উপস্থাপন করেন। ব্রহ্মপুত্র বুড়িগঙ্গারূপী শীতলক্ষ্যার এই কুৎসিত চেহারা দেখে মর্মাহত হন, রেগে গিয়ে তার অবগুণ্ঠন উন্মোচনের পর লক্ষ্যার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন ও তার সঙ্গে মিলিত হন। এরপর দুজনের মিলিত স্রোতধারা একই সঙ্গে প্রবাহিত হতে থাকে।
এদিকে পরশুরাম তীর্থভ্রমণ শেষে ফিরে এসে দেখেন, যে ব্রহ্মপুত্রকে তিনি মানুষের উপকারার্থে সমতল ভূমিতে নিয়ে এসেছিলেন, যাকে তিনি জগতের শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম নদরূপে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, তিনি শীতলক্ষ্যার সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। পরশুরাম দুজনকে অভিশাপ দিলেন। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র পরশুরামের যে উপকার করেছিলেন সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ক্ষমা চাইলেন। পরশুরামের মনে দয়ার উদ্রেক হলে তিনি ব্রহ্মপুত্রের পাপ মোচনের অলৌকিক শক্তি হরণ করে নিয়ে শুধু বৎসরের একটি দিনেই তার অলৌকিক শক্তি অক্ষুন্ন রাখেন। চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতেই থাকে সেই অলৌকিক শক্তি। তাই প্রতিবছর চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে লাঙ্গলবন্দে স্নান অনুষ্ঠিত হয়।