দেশে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, আত্মহত্যা, পিতা কর্তৃক সন্তান খুন, পুত্র/কন্যা কর্তৃক পিতা-মাতা খুন, বর্ডার এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশী খুন, র্যাবের হাতে মাদক ব্যবসায়ী বা চিহ্নিত সন্ত্রাসী খুন প্রভৃতি বেড়েই চলেছে। রাজধানীতে থানার (Police Station) সংখ্যা দ্বিগুন করা হয়েছে। কিন্তু অপরাধ বা অপরাধীর সংখ্যা কমে নাই বরং বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অপরাধের কারিগরি কৌশল হয়েছে পরিবর্তন। হত্যা প্রতিশোধের জন্য হয়ে থাকে বা এলাকার প্রভাব প্রতিপত্তি, জমি দখল, বাড়ী/ব্যবসা দখল প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে হত্যা একটি ভিন্ন বিষয়, যা পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে হয়ে আসছে, যেখানে আইন শৃঙ্খলা মেইটেইন করা অনিশ্চয়তায় থাকে, যেখানে মনুষের মধ্যে সীমা লংঘনের প্রবৃত্বি প্রকট ভাবে দেখা দেয় সেখানেই চলে হত্যাযক্ষ্য।
আরেক প্রকার হত্যা রাষ্ট্রীয় মদদে হয়ে থাকে যেমন-রোহিঙ্গাদের উপরে মিয়ানমার সরকারের হত্যাযক্ষ্য, এন.আর.সি বাস্তবায়নের জন্য মোদী সরকার কর্তৃক ভারতীয় মুসলমানদের উপর হত্যাযক্ষ্য, ১৯৭১ সনে পাকিস্তানী বরবর পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক বাংঙ্গালীদের উপর হত্যাযক্ষ্য প্রভৃতি। পক্ষান্তরে বলা যায় যে, আমাদের সমাজে পারিবারিক কলহের কারণেই স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী খুন, সন্তান হত্যা করে নিজে আতœহত্যার চেষ্টা প্রভৃতির মূল কারণ হলো সংসারে অভাব অনটন। জনগণ যদি রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বন্টনের অংশীদার হতো তবে দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দারিদ্র সীমার নীচে বাস করতো না। দারিদ্রতার কারণেই চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা হয়ে থাকে। ধনীর দুলালরা অনেকেই মাদক সেবন করে বটে, কিন্তু মাদক কারবারী যাদের র্যাব বা পুলিশ ক্রস ফায়ার করেছে তাদের মোটামোটী সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দারিদ্রতার কারণে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হয়েছে, দারিদ্রতার জন্য তারা লেখা পড়া করতে পারে না এবং একই কারণে গডফাদারদের নিয়ন্ত্রণে তারা মাদক সাপ্লাইয়ার হিসাবে কাজ করে, বিনিময়ে পেট ভরে ভাত খেতে পারে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের অঙ্গীকার “সম্পদের সুষম বন্টনে” রাষ্ট্র সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে গরীব দিন দিন হচ্ছে পথের কাঙ্গাল এবং ধনীরা গড়ে তুলছে সম্পদের অট্টালিকা। অথচ ০৪/১১/১৯৭২ ইং তারিখে “বাংলাদেশের সংবিধান” জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ সম্পদের সুষম বন্টনের প্রশ্নে রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে নাই। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, “সকল নাগরিকের জন্য আইনে শাসন, মৌলিক অধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।” অত্র আলোচনায় ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক’ সাম্যের উপর আলোকপাত করে বলতে চাই যে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় জন্য আদৌ রাষ্ট্র কর্তৃক কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছি কি? বাংলাদেশে ধনী ও গরীবের যে আকাশ পাতাল ডিফারেন্স সেখানে কি ভাবে সাম্যের অবস্থার সৃষ্টি হবে?
অর্থ লোভী পাসুন্ডরা অর্থ উপার্জনে সাধারণ মানুষের রক্ত যে ভাবে চুষে খায় তাতে মনে হয় টয়লেট থেকে কামড় দিয়ে টাকা তুলে নিতেও তাদের বিবেক কুন্ঠিত হবে না। এক পাকিস্তানী নেতা যিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, (পরবর্তীতে আদালতের রায়ে ফাসিতে মৃত্যু) এক সময় বলে ছিলেন যে, “মুজে শরাব পিতে হায় জুরুর, লেকিন গরীবোকি খুন পিতা নেহি” অর্থাৎ “আমি নিশ্চয় মদ খাই বটে, তবে গরীবের রক্ত পান করি না” (তবে ষড়যন্ত করে ১৯৭১ ইং সনে তিনি বাঙ্গালীদের রক্ত পান করে ছিলেন)। এখন প্রশ্ন হলো যতদিন অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের কালো পথ রাষ্ট্র বন্ধ না করবে, ততদিন পর্যন্ত গরীবের রক্ত শোষন অব্যাহত থাকবে। নীতিনির্ধারকদের অর্থাৎ যারাই ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছে তাদের খাই খাই অভ্যাসের কারণে বাংলাদেশ হয়েছে একটি সিষ্টেম লসের দেশ, ব্যতিক্রম যা আছে তার সংখ্যা মাইক্রোসকোপে দেখতে হবে। এ দেশে যে কোন অবৈধ কাজের জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্রই সেল্টার দিয়ে থাকে। এ দেশে আইন দু ভাগে প্রয়োগ হয় বিধায় টাউট, বাটপার, অর্থ পিচাশরা সরকারী দলের আশ্রয় খোজে, আর সরকারী দল করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা পুলিশ তাদের গায়ে হাত দেয় না, যখন সীমা লংঘনের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন বিধি বাম হলে সমালোচনার আঘাত যখন রাষ্ট্রের গায়ে আঘাতের পর আঘাত হানে তখনই হয় বিপত্তি, ফলশ্রুতি শুরু হয় অভিযান, কোথাও লোক দেখানো, কোথাও জেনুইন অভিযান যা নির্ভর করে অভিযানকারী কর্মকর্তার উপর। কিন্তু কিছু দিন পার হলেই মূখ থুবড়ে পরে সে অভিযান। হাক ডাক যতই হউক, যত গর্জে তত বর্ষে না।
একটি জনগোষ্টির সার্বিক স্বাধীনতা শুধু মাত্র একটি ভৌগলিক সীমা রেখার উপর নির্ভরশীল নহে। তবে ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা কায়েম থাকাই স্বার্বভৌমিকতার মূল উপাদান। রাষ্ট্র স্বার্বভৌমিকভাবে স্বাধীন হলেও সর্বস্তরের জনগণ যদি এর সুফল ভোগ করতে না পারে তবে তখন সে স্বাধীনতার সূযোগের অপব্যবহারে সৃষ্টি হয় শ্রেণী বৈষম্য। সে বৈষম্যের কষাঘাতে বাংলাদেশ এখন রক্তাক্ত, অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিকের জন্য স্বাধীনতার সুফল এখন “ডুমুরের ফুল” মাত্র। এক পেশে বা অনৈতিক শাসন ব্যবস্থা কোন দিনই সমষ্ঠিগত কল্যাণ বয়ে আনে না। সংবিধানের পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রস্তাবনায় আরো বলা হয়েছে যে, “বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি স্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখা এবং ইহার রক্ষন, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য।” কিন্তু সে মতে “জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি” বাস্তবায়নের জন্য বিগত ৫০ বৎসরে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ দেখাতে পারে নাই। রাষ্ট্রীয় সাহায্য যথা বয়স্ক ভাতা, ভিজিবি কার্ড, ত্রান, অনুদান, দান খয়রাত প্রভৃতি এবং একজন নাগরিককে “স্বনির্ভর” বা স্বচ্ছল করার পদক্ষেপ নেয়া এক কথা নহে। রাষ্ট্রীয় সাহায্য বা দান খয়রাত বা রিলিফের দূর্নীতি কথা বাদ দিলেও প্রতিটি নাগরিককে স্বয়ং সম্পূর্ণ করার পদক্ষেপ রাষ্ট্রকে নিতে হবে, এ পদক্ষেপ কোন সামাজিক সংগঠন বা এন.জি.ও কর্তৃক সম্ভব নহে। বাংলাদেশের কিছু এন.জি.ও এ মর্মে কিছু পদক্ষেপ নিলেও সম্পদ অর্জনের যে মনোপলি পদক্ষেপ একটি শ্রেণীর নিকট বন্ধী হওয়ার কারণে এন.জি.ও পদক্ষেপ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এন.জি.ও ঋণ গ্রহণকারীদের সুদের বোঝা অনেক বহন করতে হয় বলেই অনেক ঋণ গ্রহীতাই স্বচ্ছলতার পরিবর্তে পা পিছলে পড়ে যায়, যারা সফল তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এখন বা সম্প্রতিকালে যারা প্রতিষ্ঠা করেছেন বা করছেন তারা কেহই সেবার উদ্দেশ্যে করছেন না। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন বানিজ্যিক ভিত্তিতে চলে। এখন হাসপাতালের মতই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি লাভজনক একটি ব্যবসা। বেসরকারী উদ্দ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ঢাকায় কোন কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র/ছাত্রীদের মাসিক বেতন দিতে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার যা একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মাসের খরচের সমতুল্য। সম্প্রতি করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে শতাধিক বাংঙ্গালী ইটালীতে গিয়েছিল, কিন্তু ইটালী বিমান বন্দরে পজেটিভ সনাক্ত হওয়ায় ফিরতি বিমানে তাদের বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠানো হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে যারা করোনা সম্পর্কীত ভূয়া/জ্বাল রিপোর্ট দেয় তাদের একমাত্র উদ্দেশ্যে বিবেক বিক্রি করে অঢেল বিত্তশালী হওয়া, বিত্তশালী হওয়ার নেশায় কিছু মানুষ তাদের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। অবস্থাটা যেন এরকম যে, “ওলট পালট করে দে মা লুটে পুটে খাই”।
সমাজে ভদ্র চেহারার লোক হিসাবে পরিচিত যারা প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয় কর্ণধার এবং আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর বড় বড় কর্মকর্তাদের সাথে ছবি তোলার জন্য লোক দেখানো কিছু জনহিতকর কাজ করে এবং এ ছবিগুলিই দূবৃত্তায়ন করার জন্য অস্ত্র হিসাব ব্যবহার করে। অযাচিত ছবি বা ফটো শেসনের বিষয়ে কর্তা ব্যক্তিদের আরো সচেতন থাকা দরকার। আমাদের রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার সূযোগে “রাজনীতি” দূরবৃত্তদের পকেটস্থ হওয়ায় কোন ধারাবাহিকতা ছাড়াই অর্থের প্রভাবে যে কোন দূরবৃত্ত যে কোন সময় রাজনীতিতে ঢুকে গোটা পরিবেশকে কুলষিত করে ফেলেছে।
সাধারণ মানুষ এখন দাড়াবে কোথায়? “লাজ ফার্মা” দেশে একটি বিখ্যাত ও বুনিয়াদী ঔষধ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসাবে মানুষ জানতো। তাদের ঔষধের দোকান থেকে মেয়াদ বহির্ভূত ঔষধ উর্দ্ধার করেছে র্যাব। বর্তমানে সমাজে বিশ্বাস করার মত কোন জায়গা আর রইলো না। এর মূল কারণও বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার নেশা, যে নেশায় পুড়ে যাচ্ছে দেশ ও জাতি।
দেশে অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণ কোথাও অর্থনৈতিক দৈন্যতা ও কোথাও অঢেল সম্প্রতির মালিক হওয়ার নেশা। আইন করে এ অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না, পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়েও কোন লাভ হবে না, যতক্ষন না রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বন্টন না হবে। ফলে সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ হলো রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বন্টন যা ছিল স্বাধীনতা পূর্ব স্বাধিকার আন্দোলনের মূল দাবী।- প্রেস বিজ্ঞপ্তি
লেখক: তৈমূর আলম খন্দকার
রাজনীতিক ও আইনজীবী