নারায়ণগঞ্জ মেইল: বিএনপিতে সদ্য যোগদানকারী শিল্পপতি মাসুদুজ্জামান মাসুদ এতদিন বেশ শালিন ভাষায় কথা বলেছেন। বক্তব্য বিবৃতিতে ছিলো বিনয়ের সুর। রাজনৈতিক জনসভা গুলোতে সকলকে নিয়ে ঐক্যের ডাক দিতেন কিন্তু হঠাৎ করেই তার সেই বিনয়ী সুর পাল্টে গেলো এবং তিনি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন। কথার অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করলেন নারায়ণগঞ্জ বিএনপির পোড়খাওয়া ত্যাগী সব নেতাকর্মীদের। মডেল মাসুদের আকস্মিক এই বদলে যাওয়ার কারণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির কিং মেকার মোহাম্মদ আলীর ছোঁয়া বলেই মনে করছেন রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, নারায়ণগঞ্জ ৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী শিল্পপতি মাসুদুজ্জামান মাসুদ ওরফে মডেল মাসুদ সোমবার (১৩ অক্টোবর) দুপুরে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহবায়ক মোহাম্মদ আলী যিনি নারায়ণগঞ্জের দুর্ধর্ষ গডফাদার শামীম ওসমান এবং সেলিম ওসমানের পা চাটা দালাল হিসেবে নারায়ণগঞ্জে পরিচিত।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বেশ আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেন মাসুদুজ্জামান মাসুদ। বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জ বিএনপির সিনিয়র নেতাদের আক্রমণ করে কথা বলেন তাদের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নির্বাচনেও কেউ পাস করতে পারবে না বলে হুঁশিয়ারি জানান তিনি। এ সময় তাকে বেশ উত্তেজিত দেখা যায় এবং কন্ঠে ছিল ঝাঁঝ।
এদিকে মডেল মাসুদের আকস্মিক এই আক্রমণাত্মক বক্তব্যে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা মাসুদের কন্ঠে পতিত সরকারের গডফাদার ওসমান পরিবারের সুর খুঁজে পেয়েছেন।
তৃণমূল মনে করে, মাসুদুজ্জামান মাসুদ সদ্য বিএনপিতে যোগদান করেছেন। তাছাড়া তিনি একজন জন প্রতিনিধি হতে চাইছেন। এমতাবস্থায় তার ভাষা হবে শালীন এবং ব্যবহার হবে আন্তরিক ও বিনয়ী এতদিন পর্যন্ত তিনি এটা বজায় রেখেছিলেন কিন্তু সোমবার কিং মেকার মোহাম্মদ আলীর ছোঁয়ায় তিনি পুরোপুরি বদলে গেছেন কারণ মোহাম্মদ আলী গত ১৫ বছর নারায়ণগঞ্জের ভয়ঙ্কর গডফাদার ওসমান পরিবারের দালালি করেছেন।
তৃণমূলের দাবি, নারায়ণগঞ্জের রাজনীতির কথিত কিং মেকার ও সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ আলী ছিলেন ওসমান পরিবারের ঘনিষ্টজনদের মধ্যে অন্যতম। প্রয়াত নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে সেলিম ওসমান নির্বাচনে অংশ নিলে প্রথমে সেলিম ওসমানের পক্ষে ভোট চেয়ে ওসমানীয় সম্রাজ্যে যোগ দেন। এরপর থেকে ওসমান পরিবারের সাথে আওয়ামীলীগের বিভিন্ন কর্মসূচীতে অংশ নেন।
মোহাম্মদ আলী নিজের রাজত্ব ধরে রাখতে সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী ও ওসমান পরিবার উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক রাখতেন। ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর ওসমান পরিবার পালিয়ে গেলেও তাদের বিভিন্ন সেক্টর নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা চালিয়ে যান মোহাম্মদ আলী। তার ভাতিজা ও ভাগ্নেরা দখলবাজী শুরু করেন ফতুল্লার বিভিন্ন এলাকায়। তবে ২৪ মার্চ দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে অনুদান বিতরণ অনুষ্ঠানে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে তোপের মুখে পড়েন মোহাম্মদ আলী। দীর্ঘদিনে অভ্যাসের কারণে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন তিনি। এই ব্যক্তব্যকে কেন্দ্র করে মোহাম্মদ আলীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রতিরোধের ঘোষণা দেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপুসহ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দরা। পরবর্তিতে সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষমা চান মোহাম্মদ আলী।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ বিএনপিতে দীর্ঘদিন যারা রাজপথে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে তাদেরকে হতাশ করে দিয়ে ৫ আগস্টের পর থেকে শিল্পপতি মাসুদুজ্জামান মাসুদ ওরফে মডেল মাসুদ নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষের মনোনয়ন চাইছেন। এ লক্ষ্যে তিনি ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অতি সম্প্রতি তিনি বিশাল আয়োজন করে ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে বিএনপিতে যোগদান করেন যা দেখে তৃণমূল নেতাকর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
তৃণমূল মনে করে বিএনপির গত ১৭ বছরের আন্দোলন সংগ্রামে একদিনের জন্যও রাজপথে দেখা যায়নি মডেল মাসুদকে। বরং সে সময়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এমপিদের সভা সমাবেশে প্রায়ই দেখা মিলেছে তার। দুঃসময়ের আন্দোলন সংগ্রামে যখন সারা দেশে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছে তখন মাসুদুজ্জামান মাসুদ পুরোপুরি ব্যবসায়ী মেজাজে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সমান তালে ব্যবসা করেছেন, কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
গত ১৫ বছরে সরকার বিরোধী আন্দোলনের মিটিং মিছিলে একবারের জন্যও দেখা মিলেনি মডেল মাসুদের। সারাদেশে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা সরকারের মামলা হামলায় জর্জরিত হলেও মডেল মাসুদকে কোনদিন পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ বিরক্ত করেনি। দলের দুঃসময় কেটে যাওয়ায় মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন এই ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগের আমলে কামানো কোটি কোটি টাকা নিয়ে নেমে পড়েছেন মনোনয়ন কেনার প্রতিযোগিতায়।
তবে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিগত দিনে যারা রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদেরকেই দলীয় মনোনয়ন দিতে হবে। যারা আওয়ামী লীগ আমলে মামলা হামলা খায়নি, আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে মিলেমিশে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন আর মোটা টাকার মালিক হয়েছেন, তাদেরকে মনোনয়ন দেয়া হলে তারা মানবেন না। এবারের দলীয় মনোনয়ন যাতে টাকায় বিক্রি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে দলের হাই কমান্ডের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এই এলাকার তৃণমূল নেতাকর্মীরা।