প্রেস বিজ্ঞপ্তি: ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে রাষ্ট্ৰীয় ভাবে মুজিব বর্ষ পালনের ঘোষনা নেয়া হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে তাঁর শততম জন্মাৎসব করার প্রত্যয়ে বাঙালী জাতিও আজ প্রস্তুত। জাতি যখন বঙ্গবন্ধুর জন্মশত জন্মজয়ন্তি উদযাপনের প্রস্ততি নিচ্ছে ঠিক সেসময়ে মনে পড়তে ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের সেই হৃদয় বিদারক ঘটনার কথা। বিশ্ব ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশত জন্মজয়ন্তির এই উদ্যোগের প্রেক্ষিতে আমার তাঁকে দেখা কৈশোরকালের স্মৃতির পাতায় যে উজ্জল ইশতেহার জ্বলজ্বল করে জ্বলছে- সেই ১৯৭১ এর ৭ই মার্চের স্মৃতির কথা কভু ভোলার নয়, ভুলতেও চাই না। সেই ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের দিনটিকে ঘিরে সারা দেশের মানুষের মতো নারায়ণগঞ্জ শহরের মানুষেরও কৌতুহল কম ছিলো না। যার প্রেক্ষিতে সেদিন দলে দলে মানুষ বাসে, ট্রাকে, ট্রেনে এবং অন্যান্য গাড়িতে করে সকাল থেকে ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। সেই দলেরই একজন হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। এইদিন আমারই এক মামার জিপ করে নারায়ণগঞ্জ থেকে রেসকোর্স ময়দানে আমি গিয়েছিলাম । রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে দেখি মানুষের মহাসমুদ্রে এক পর্যায়ে মামাকে হারিয়ে ফেলি । ততোক্ষণে মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুরু হয়ে গেছে। দূর থেকে তাঁকে যতটুকু পেরেছি দেখেছি। ভাষনে শেষে অবার নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি ট্রাকে করে। তারপর কেটে গেছে কয়েকটি বছর।
১৯৭৫ এ স্কুলে পড়াকালীন সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাটি আমার মনে ভীষণ ভাবে দাগ কেটে যায়। স্বাধীনতার স্থপতি, দেশের রাষ্ট্রপতিকে কেনো হত্যা করা হবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়ি। শুরু হয় ছাত্রলীগের মাধ্যমে। হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ আর ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেই বিশেষতঃ ওই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদের তীব্রতা বুকের মধ্যে ধারণ করে রাজনীতির পথে পা বাড়াই। সেই ১৯৭৫ থেকে ২০২০, এই রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় কতো আশাতীত ঘটনা যেমন আমার রাজনৈতিক স্লীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। একই ভাবে অযাচিত্র বহু ঘটনার প্রেক্ষিতে জীবনে নেমে এসেছিলে ভয়াবহ অন্ধকার। সব কিছু পিছনে ফেলে আজ আমি আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে এবং সাম্প্রতিক বিশ্বরাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, গনতন্ত্রের মানসকন্যা, জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্নেহার্দ্রতায় আমি আমার এই ক্ষুদ্র রাজনৈতিক জীবনকে আজীবন এগিয়ে নিয়ে যাবো- এটিই আমার দৃঢ় প্রত্যয়।
ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ‘৬২ এর ছাত্র আন্দোলন, ‘৬৬ এর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত ৬-দফা আন্দোলন এবং ৬৯ এর গণ অভূখনের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালি জাতি ঘৃণায় ফেটে পড়ে- পাকিস্তানীদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয় যে তারা আর পরাধীনতা মানতে ইচ্ছুক নয়। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ৬-দফা সনদে বাঙালির স্বাধিকারের কথা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ ছিলো। এবং তারই ভিত্তিতে পরবর্তীতে ৬৯ এর গন অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। রাজনৈতিকভাবে তখনো অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পকিস্তানীদের বিরুদ্ধে অন্দোলন চালিয়ে গেলেও এক পর্যায়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসী নেতৃত্বে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে এসে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যায়। যার শতভাগ প্রভাব পড়ে ১৯৭০ এর নির্বাচনে। যে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপণ করে বাঙ্গালী জাতি আওয়ামীলীগের নৌকা প্রতীককে সামনে রেখে ১৬৭ আসনে বিজয়ী করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ৬ দফাকে সামনে রেখে এতোটাই আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ে যায় প্রচন্ড উত্তাল তরঙ্গ বাঙালিকে ৬৯ এর এ অভূত্থানের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড় করিয়ে দেয়। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচরী, শ্রমজীবী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের জনতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দেলনের ডাকে ঘর থেকে রাজপথে নেমে আসে।
৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করলেও রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে পাক শাসকচক্র। যেনো বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতার সংস্পর্শে আসা থেকে বঞ্চিত রাখা যায় এবং এই ধারা পাকিস্তানী শাসকরা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানা ষড়যন্ত্র হত্যা, গুম, খুনের ঘটনা ঘটাতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা দেখে বাঙালি জাতি উত্তাল সমুদ্রের মতো ফুঁসে ওঠে। এবং ধাপে ধাপে আন্দোলন এগিয়ে যায় আর বাঙালির সম্মুখে চলে আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ দিনটি। যে দিনটি ছিলো বাঙালি জাতির মুক্তির সনদের চূড়ান্ত পর্যায়। এবং বঙ্গবন্ধু সেই ৭ই মার্চে রেসকোর্সের ময়দান থেকে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষনাকে সামনে রেখেই সমগ্র বাঙালি জাতি প্রস্তুতি নিতে থাকে চূড়ান্ত লড়াইয়ের। এবং তারই ভিত্তিতে আন্দোলন দমাতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ১৯৭১ এর ২৫ মার্চে মারাণাস্ত্র নিয়ে রাতের আঁধারে বাঙালির ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, চালায় পৃথিবীর নৃশংসতম এক হত্যাযজ্ঞ। এই অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ছড়িয়ে দেয়া হয় সারাবাংলা এবং বিশ্বব্যাপি । সূচিত হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
২৫ মার্চ রাতেই ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানের কারাগারে। যে কারাগারের ফাঁসির মঞ্চের পাশে তাকে দীর্ঘ নয় মাস অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে বন্দী রাখা হয়। কিন্তু নয় মাসের যুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর ‘৭১ এ বাঙালি জাতি বীরের মতো মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক ভাবে বহুদেশ এবং দেশের মানুষ ৩০ লক্ষ বাঙালি হত্যা এবং ২ লক্ষ ৭৫ হাজার মতান্তরে ৫ লক্ষ মা-বােনের সম্ভ্রম হারানো নির্মমতার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা পোষণ করলেও ওই সময় আমেরিকা, চীনসহ কিছু দেশ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। তবে এ প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য ভারত এবং রাশিয়ার কাছে চিরঋনী হয়ে আছে। কেননা তৎকালীন স্নায়ুযুদ্ধের সময় রাশিয়ার যদি ভারতের আহবানে তথা প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর আহবানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দান থেকে বিরত থাকতো তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাসহ সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের সরকার এবং জনগণ বাঙালি শরনার্থীদের নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে এবং প্রায় এক কোটি শরনার্থীকে সেই সময় ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছিলো। বাঙালির পাশাপাশি ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার এবং সোলজারও আত্মাহুতি দান করেছে। ইতিহাসে যা এক হৃদয়বিদারক বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
প্রসঙ্গক্রমে তাই বলা চলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে নিয়ে যেতে ভারত এবং রাশিয়ার ছিলো অকৃত্রিম ত্যাগ ও সহানুভূতি। তাদের এই সহানুভূতির কথা বাঙালি জাতি আজও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেক মুজিবুর রহামন তাঁর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি দেশে ফিরে যথারীতি সংবিধান রচনা, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পূণর্গঠন, শরনার্থীদের ফিরিয়ে আনাসহ রাষ্ট্রীয় কাজ সম্পন্নের কাজে অতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর বসবাস তখনো ধানমন্ডির ৩২ নম্বরেই। এরই মাঝে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে একটি পূর্ণাঙ্গ সুস্থির পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে বঙ্গবন্ধু নিরন্তর কাজ করে যেতে থাকেন।
এরই মধ্যে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নীলনকশা সামনে রেখে ঘাতকেরা ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মম ভাবে হত্যাকরে। বিদেশে অবস্থানের কারণে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রাণে বেঁচে যান। ও প্রায় ৬ বছর ভারতে কাটিয়ে অবশেষে সকল ভয়ভীতি, শংকা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের এক বৃষ্টিভেজা দিনে (১৭ মে) স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বর্তমান বাংলার মহান নেত্রী, জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে অতঃপর এক নতুন যুগ, নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। ইতিহাসের এই অধ্যায়ের পরতে পরতে উল্লাসিত হতে থাকে আন্দোলন, সংগ্রাম, ত্যাগ, অধিকার আদায়, বঞ্চিত মানুষের কল্যাণে নিবেদিত এক রাজনীতিকের আত্মবিশ্বাস জাগা মুখবর। যার নাম বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে অবিস্মরনীয়তার আমােঘ অক্ষরে। আর তিনি হলে প্রজ্ঞায়, বিচক্ষনতায়, আত্মবিশ্বাসে, মানবিকতার প্রতিবিম্বিত মানুষ, বঙ্গবন্ধু তনয়া, অকুতােভয়, অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিসিক্ত, অপরাজেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আজ তাঁরই নেতৃত্বে উদযাপিত হতে যাচ্ছে তাঁর পিতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশততম বার্ষিকী। ১৯৭১-এ পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থানটি যিনি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার সেই মহান স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধের মহান নায়ক, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামন এর জন্মশত জন্মোৎসব বৎসবের লক্ষ্যে ২০২০ সালকে ‘মুজিব বর্ষ’ হিসেবে পালনের যে প্রস্তুতি সমগ্র বাঙালি জাতি গ্রহণ করেছে। এই উৎসব পালন প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু’কে জানাই সশ্রদ্ধ অভিনন্দন।
লেখক: আইনজীবী, সাধারন সম্পাদক, নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামীলীগ।