এসপি হারুনের পরে ওসি আসাদ, ফের প্রশ্নবিদ্ধ না:গঞ্জ পুলিশের ভাবমূর্তি

নারায়ণগঞ্জ মেইল: নারায়ণগঞ্জের স্কুল ছাত্রী দিশামনি ফিরে আসার ঘটনায় তোলপাড় চলছে প্রশাসনে। ধর্ষণ ও হত্যার দায় স্বীকার করে আসামীদের জবানবন্দি দেয়ার পরে সে নিহত কিশোরি ফিরে আসার ঘটনা শুধু নারায়ণগঞ্জেই নয়, সারা দেশেই হইচই ফেলে দিয়েছে। সেই সাথে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের ভামূর্তিও প্রশ্নের মুখোমুখি এসে দাড়িয়েছে। নারায়ণগঞ্জ পুলিশের এস সময়ের বিতর্কিত এসপি হারুন অর রশিদের কারনে ক্ষুন্ন হওয়া ভাবমূর্তি গত প্রায় এক বছরের কঠোর প্রচেষ্টায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেও এক দিশামনির ঘটনায় তা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর এর পিছনে অভিযোগের তীর যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামানের দিকে।


জানা যায়, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ জেলার ভাবমূর্তি সব সময়ই উজ্জল ছিলো। কিন্তু ২০১৪ সালে মর্মান্তিক সেভেন মার্ডারের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের সেই উজ্জল ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পরে, পরিচিতি পায় সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে। সেই সন্ত্রাসের জনপদ নারায়ণগঞ্জকে আবারো তার ঐতিহ্যবাহী রূপে ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব সে সময়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া ড. খন্দকার মুহিদউদ্দিনের। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ প্রশাসন জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। খন্দকার মহিদের সে ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখেছিলেন তার পরবর্তী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া মইনুল হকও, কিন্তু নারায়ণগঞ্জ পুলিশের সেই ভাবমূর্তি একেবারেই ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছিলেন বিতর্কিত পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ। চাঁদাবাজি আর লুটপাটের মহোৎসবে মেতে উঠা এই বিপথগামী পুলিশ সুপারের বিতর্কিত কর্মকান্ডে আবারো প্রশ্নের মুখে পরেছিলো নারায়ণগঞ্জের পুলিশ প্রশাসনের ভাবমূর্তি। হারানো সেই ইমেজ ফিরিয়ে এনেছিলেন বর্তমান পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম।


সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের পর স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে কয়েক মাস ধরে আলোচনায় ছিলেন বিতর্কিত এসপি হারুন। সবশেষ আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেলের স্ত্রী ও ছেলেকে আটকের ঘটনায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় সারা দেশে। এ ঘটনায় ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে নারায়ণগঞ্জ জেলা থেকে বদলি থেকে করে সদর দপ্তরে ট্রেনিং রিজার্ভ (টিআর) পদে বদলি করে।


এসপি হারুন যাওয়ার পরে নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন জায়েদুল আলম। তিনি এসে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন এবং প্রায় সফলও হন। তার নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ প্রশাসন গত প্রায় এক বছর বিতর্কহীনভাবেই কাজ করে যাচ্ছিলো। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের বিরামহীন সেবামূলক কর্মকান্ড প্রশংসিত হয়েছে সর্বত্র। কিন্তু স্কুল ছাত্রী দিশামনির ঘটনায় তাদের সে অর্জনে জল ঢেলে দিলেন যেনো নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি আসাদুজ্জামান।


বিশ্বস্ত সূত্রে প্রকাশ, নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান ছিলেন বিতর্কিত এসপি হারুন অর রশিদের ঘনিষ্টজন। গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার ওসি হিসেবে কর্মরত থাকালীন সময়ে গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে এক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছিল। হারুন অর রশিদ নারায়ণগঞ্জে আসার পর আসাদুজ্জামানকে ফতুল্লা মডেল থানায় আনতে তৎকালীন ওসি শাহ মঞ্জুর কাদিরকে বেকায়দায় ফেলে বদলী করার। কিন্তু শাহ মঞ্জুর কাদিরকে বদলী করলেও নিজের ফতুল্লা থানার ওসির দায়িত্ব দেয়া হয় আসলাম হোসেনকে। এরপর আসলাম হোসেনকে বেকায়দায় ফেলে বদলী করিয়ে আসাদুজ্জামানকে ফতুল্লায় আনার চেষ্টা চালান হারুন অর রশিদ। এতে ব্যর্থ হয়ে সদর ওসি কামরুল ইসলামকে ডিবিতে বদলী করে সদর থানায় আসাদুজ্জামানকে নিয়ে আসছেন। কথিত আছে কোটি টাকা খরচ করে নারায়ণগঞ্জে এসেছেন আসাদুজ্জামান। আসাদুজ্জামান সদর থানায় যোগদানের পর থেকেই আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতিসহ বেআইনী কাজ করার অভিযোগ রয়েছে আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে ।

এছাড়াও সেবা নিতে আসা মানুষের সাথে খারাপ আচার করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সদর থানা আসাদুজ্জামান আসার পর থেকে অসংখ্য ভূয়া মামলা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জমি সংক্রান্ত ঝামেলায় চাঁদাবাজী মামলা করে কোটি টাকার জমি দখল করিয়ে দেয়াসহ নানা বেআইনী কাজের অভিযোগ রয়েছে। প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে থানার ভিতরে দেনদরবার চলে অসছিলো ওসি আসাদের নির্দেশে। তাছাড়া এসব কাজের জন্যে ওসি আসাদের ছিলো কিছু সোর্স ও দালাল বাহিনী। যারা বিভিন্ন জায়গা সম্পত্তির ভেজাল মিমাংসার কথা বলে ভুক্তভোগীদের থানায় নিয়ে আসতেন আর সমাধানের নামে মোটা অংক হাতিয়ে নিতেন সদর ওসি আসাদুজ্জামান। কথিত আছে সদ্য সমাপ্ত ঈদুল আযহার অস্থায়ী পশুর হাটগুলো থেকেও ওসি আসাদের নামে মোটা অংকের সম্মানী দেওয়া হয়েছিলো। এছাড়াও আসামীদের রিমান্ডে এনে তাদের স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নেওয়ার অভিযোগও ছিলো তার বিরুদ্ধে।

এদিকে সদর ওসি বিতর্কিত কাজে ব্যস্ত থাকায় শহরে ছিনতাই, মাদক ব্যবসা বেড়ে যাওয়াসহ আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে বলে দাবী সচেতন মহলের। ইজিবাইকে করে পুলিশের দুটি টিম কাজ করছে। যারা মাদক উদ্ধারের নামে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে মাসোয়ারা তুলে তার ভাগ দিচ্ছেন ওসি আসাদকে। কিছুদিন আগে আসাদের বিশেষ টিমের সদস্য এসআই ইলিয়াস হোসেন সৈয়দপুর থেকে ৩৭০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করে। বিপুল পরিমান ফেনসিডিল উদ্ধার হলেও কোন আসামী গ্রেতার করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আসামীদের ছেড়ে দিয়েছে এসআই ইলিয়াস হোসেন। কথিত আছে, ইলিয়াসসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য বেআইনীভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে তার ভাগ দেন ওসিকে। এদের মধ্যে বেশ কয়েক ইতিমধ্যে সদর থাননা থেকে বদলী করা হয়েছে।


সর্বশেষ দেওভোগের স্কুল ছাত্রী দিশামনি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় আসামীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির দেড় মাস পরে নিহত কিশোরীর ফিরে আসার ঘটনায় পুরো পুলিশ প্রশাসনকে প্রশ্নের মুখে এনে দাড় করিয়েছেন সদর ওসি আসাদুজ্জামান। জীবিত মানুষকে মৃত বানিয়ে নির্দোষ মানুষকে নির্যাতনের মাধ্যমে দোষী স্বীকার করানোর ভয়াবহ অপরাধ এখন ওসি আসাদের উপরে। আর তার এ বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারনে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পরেছে পুরো নারায়ণগঞ্জের পুলিশ প্রশাসন।


স্কুল ছাত্রী দিশামনির ফিরে আসা এবং পুলিশের নির্যাতনে মিথ্যা জবানবন্দি নেওয়ার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুলি আলম নারায়ণগঞ্জ মেইলকে বলেন, অপরাধী যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিতর্কিত কোন পুলিশ সদস্য নারায়নগঞ্জে থাকতে পারবে না। এরই মধ্যে স্বেচ্ছায় অনেকে নারায়নগঞ্জ থেকে বদলী হয়ে চলে গেছেন। দিশামনির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি আসাদুজ্জামান নারায়ণগঞ্জ মেইলকে বলেন, ঘটনা সম্পর্কে জানতে আসামীদের আবারো রিমান্ডে আনা হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

নারায়ণগঞ্জ মেইলে এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

সর্বশেষ